দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার পৈত্রিক আসন ফেনী-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সরব দেখা যাচ্ছে। হেভিওয়েট প্রার্থী বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমসহ এখন পর্যন্ত মোট ১০ মনোনয়ন প্রত্যাশী দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছেন।
তারা হলেন, ফুলগাজী উপজেলা থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ আব্দুল্লাহ, আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল মতিন ভূঁইয়া, ইলিয়াস জাকারিয়া জুয়েল, আবদুল কাদির ভূঁইয়া বাবু, এডভোকেট সাহাব উদ্দিন টিপু।
পরশুরাম উপজেলা থেকে আলাউদ্দিন চৌধুরী নাসিম ও রোকেয়া সাফদার। ছাগলনাইয়া উপজেলা থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মিজানুর রহমান ও ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল ও আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট আবদুল্লা হারুন ভূঁইয়া রাসেল।
ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া- এ তিনটি উপজেলা দুটি পৌরসভা ও চৌদ্দটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফেনী-১ আসনটি গঠিত। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে মোট ভোটার ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ৫৫ জন। হালনাগাদের পর ২০২৩ সালে তাতে আরও বেড়েছে ৫১ হাজার ৭৪২ জন। এ আসনে বর্তমান ভোটার তাই ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৯৭। ১০৬টি ভোট কেন্দ্র ও ৫৬৬টি ভোটকক্ষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে এ আসনে।
একটা সময় এই আসনকে বিএনপির দুর্গ বলা হলেও এখন শক্ত অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সবকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই নির্বাচিত হয়েছেন। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের সমীকরণ কী, তা দেখার অপেক্ষায় সবাই। দীর্ঘ সময় ধরে জোটের জাসদ প্রার্থী শিরিন আখতার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেও, এবার আর জোটের নয়, দলের প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, সংসদ সদস্য না থাকায় ক্ষমতায় থেকেও তারা বঞ্চিত হয়ে আসছেন। তাই দলের প্রার্থীর বিকল্প নেই।
এই আসনে আওয়ামীলীগের সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়াছড়িতে দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা কার্যত দ্বিধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নেতাকর্মী জানান। অপর দিকে এক সময়ের বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত আসনটিতে মহাজোট প্রার্থী হিসেবে তৃতীয়বারের মতো মনোনয়ন পেতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। ইতিমধ্যে তিনি দলীয় মনোনয়ন ফমর সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট মনোনয়ন চাওয়ার গুঞ্জনও রয়েছে।
এছাড়াও সাবেক মন্ত্রী লে. কর্ণেল (অব.) জাফর ইমাম (বীরবিক্রম) ১৯৭৯ সাল থেকে বিএনপি, পরে জাপা থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত এ আসনের এমপি-মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ সালে জাপা প্রার্থী এবং ২০০১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে এ আসন থেকে নির্বাচন করে বেগম জিয়ার কাছে হেরে যান। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, তিনি দলীয় মনোনয়ন পেলে হয়তো আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে পারেন।
অপরদিকে বিএনপিতে এখনো দেখা যায়নি ভোটের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। তবে নির্বাচনে গেলে দল যাকেই মানোনয়ন দেবে, তাকেই জয়ী করতে একাট্টা তারা। এমনটাই জানিয়েছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে তলে তলে মাঠ গোছাতে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামীও। নিজেদের প্রার্থীও ঠিক করে রেখেছেন তারা। এছাড়া রাস্তা-ঘাটে, মাঠে ও হাট বাজারে দেখা গেছে বেশকিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোস্টারও। তাদের অনেকেই খায়েশ দেখিয়েছেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার।
জানা গেছে, সদ্য ঘোষিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আসনটি পেতে আলাউদ্দিন আহমেদ উদ্দিন চৌধুরী নাসিম কিছুদিন আগ থেকে এলাকায় নৌকার পক্ষে সভা-সমাবেশ করে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। গত বুধবার ছাগলনাইয়া পৌরশহরের জমাদ্দার বাজারে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজাম উদ্দিন মজুমদারের সভাপতিত্বে এক শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় দলীয় মনোয়ন প্রত্যাশী মেজবাউল হায়দার চৌধুরী সোহেল দলকে সুসংগঠিত করা এবং করোনা মহামারী থেকে অদ্যাবধি নিজের অর্থ-শ্রম-ঘাম দিয়ে দিন-রাত নৌকার পক্ষে কাজ করার কথা উল্লেখ করে নেতাকর্মী ও ভোটারদের কাছে তার দায়বদ্ধতার কারণে দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দেন। তবে দলীয় প্রধান ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে নৌকা দিবেন তাকে নেতাকর্মীদের নিয়ে বিজয়ী করবেন বলেও জানান তিনি।
ভারত সীমান্তবর্তী এ আসনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চারবার নির্বাচিত হয়ে দুইবার আসন ছেড়ে দেওয়ায়, তার ছোট ভাই সাইদ ইস্কান্দার উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হন। গত ১১টি সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি দুবার তাদের দখল নিতে পারলেও, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৩ সালের পর এ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয়ে যায়। একবারও দলটির কেউই নির্বাচিত হতে পারেনি এখান থেকে। গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেওয়ায় এ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন মহাজোটের প্রার্থী। তবে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চায় দলের প্রাথী, জোটের নয়। খালেদা জিয়ার পৈত্রিক ভিটার এ আসনটি স্থায়ীভাবে শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে চায় তারা। নেতা-কর্মীরা বলেন, একবার আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচিত হলে, আর কেউই ভোটে জিততে পারবে না এখানে।
গত দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য থাকায় উন্নয়নের ফিরিস্তি উল্লেখ করে আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও মহাজোটের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী জাসদ (ইনু)। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য শিরিন আখতার বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে এ আসনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। নারী ক্ষমতায়নে এখানে ব্যাপক সফলতা রয়েছে। আবারও যদি মনোনয়ন দেওয়া হয়, জনগণ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাজায় রাখতে মহাজোটের প্রার্থীকেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবে। শিরিন আখতার আরও বলেন, আবার যদি তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাহলে অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও নারী শিক্ষাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।
বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করায় আসনটিতে সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে নির্বাচন করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী থাকবেন কি না, তা নিয়ে কেউ খোলাসা করেনি। তবে খালেদা জিয়া যাকেই প্রার্থী দেবেন, তাকেই বিপুল ভোটে নির্বাচিত করতে পারবেন বলে জানিয়েছে বিএনপি নেতারা।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য মো. আলমগীরের (বিএ) সঙ্গে। তিনি বলেন, সরকার উন্নয়নের নামে দেশে লুটপাট চালিয়েছে। দেশের মানুষ দেখেছে, এই সরকার কিভাবে মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালিয়েছে। কিভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। এমন অপশাসন দেখেও এই সরকারকে এবং এই দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। ভোট হলে মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীও নিজেদের প্রার্থীও ঠিক করে রেখেছেন তারা। সূত্র জানায়, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম কামাল উদ্দিনকে প্রার্থী ঠিক রেখে মাঠে কাজ করছে তারা। অপরদিকে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও দেখা গেছে প্রচারণায়। এর মধ্যে ব্যারিস্টার নিজাম উদ্দিন ভূঞাঁ রাসেল নামের এক প্রার্থীর পোস্টার দেখা গেছে বিভিন্ন হাট-বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়। অন্যদিকে এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আলহাজ এমএ কাসেম, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি নুরুন নেওয়াজ সেলিম ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহর নাম শোনা গেলেও নির্বাচনী মাঠে তাদের দেখা যাচ্ছে না।
এমআর