মানুষ সৃষ্টিজগতের সেরা জীব। অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। মানুষের এত বৈশিষ্ট্যের মাঝে যোগাযোগ দক্ষতা একেবারেই স্বতন্ত্র। যোগাযোগেরই এক মাধ্যম কথা বলা কিংবা বক্তব্য/বক্তৃতা দেওয়া। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরাআনুল কারীমে সূরা আর রাহমানে বলেছেন, عَلَّمَہُ الۡبَیَان অর্থঃ তিনিই শিখিয়েছেন বাক কৌশল। (সূরা আর রহমান, আয়াত: আয়াত ০৪)
মানুষের বাক কৌশল একটি বিশেষায়িত গুন যা স্বতন্ত্রভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উল্লেখ করেছেন। আমাদের অনেকের চিন্তা করার শক্তি বেশ প্রখর কিন্তু সেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশের জন্য গুছিয়ে কথা বলতে গেলে খুব কষ্ট হয়। একধরনের ভীতি কাজ করে। মানুষের সামনে কিছু বলতে গেলেই বুক কাঁপে অথবা কথায় আড়ষ্টভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ সেই মানুষটিই হয়ত তার পরিবারে কিংবা বন্ধুমহলে জমিয়ে আড্ডা দিতে পারে। কারও যদি এমন সমস্যা থাকে তাহলে চলুন প্র্যািক্টিক্যাল কয়েকটা টিপস শেয়ার করি যা আপনাকে এই সোশ্যাল ফোবিয়া বা এংজাইটি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে। ইনশাআল্লাহ।
প্রথম ধাপ- দুয়া করা: আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দুয়া করুন যেন তিনি আপনাকে অন্যের সামনে ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। নবী মূসা আলাইহিস সালামের দুয়াটি বেশি বেশি পড়তে পারেন।
رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ وَيَسِّرْ لِيْ أَمْرِيْ وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِيْ يَفْقَهُوْا قَوْلِي (হে আমার প্রতিপালক, আমার হৃদয় প্রশস্ত করে দিন, আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্ববার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। (সূরা ত্বাহা, আয়াত: ২৫-২৮)
নবী মূসা আলাইহিস সালাম যখন তার ভাই হারুন আলাইহিস সালামকে সাথে নিয়ে ফিরাউনকে দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন তার আগে এই দুয়া করেছিলেন। দোর্দন্ড প্রতাপশালী ফিরাউনের সামনে কথা বলতেও সমস্যা হয়নি নবী আলাইহিস সালামের। আর আপনি যাদের সামনে কথা বলবেন তারা কেউই ওরকম ক্ষমতা আর দাপটের অধিকারি নন।
দ্বিতীয় ধাপ- বক্তৃতা/বক্তব্য শোনা: বলা হয় যে, যদি কেউ একপাতা লিখতে চায় তাহলে সে যেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কয়েকটা বই পড়ে, আর যে কিছু বলতে চায় বা বক্তৃতা দিতে চায়, সে যেন অনেক বেশি বক্তৃতা শোনে। একদম বাস্তবসম্মত পরামর্শ বা উপদেশ। মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য এমন যে, সে যেমন পরিবেশে বেড়ে উঠে তেমনিভাবে চিন্তা করতে শেখে, বলতে শেখে আর তার আচরণ প্রভাবিত হয় সেই পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা। তাই যে মানুষের সামনে কথা বলতে চায়, বক্তৃতা দিতে চায়, তার জন্য বক্তব্য শোনা খুব জরুরী। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিশ্ববরেণ্য অনেক বক্তার বক্তব্য ইউটিউবে খুব সহজলভ্য। বাংলা ভাষায় সুন্দর গুছিয়ে কথা বলেন এমন অনেকেই রয়েছেন এপার বাংলা ও ওপার বাংলায়। কষ্ট করে ইউটিউবে থেকে খুঁজে নিতে হবে। অবশ্যই যারা ক্ল্যাসিকাল ধাঁচে বক্তব্য দেন কিংবা কথা বলেন তাদের কথা শুনবেন। যারা সাবলীল গতিতে লেকচার ধাঁচে কথা বলেন তাদের কথা শুনবেন। ইংরেজিতে সাবলীল বক্তব্য দেওয়ার জন্য আপনি Oxford Union এর বিতর্ক কিংবা বক্তব্য শুনতে পারেন। এছাড়াও যখন বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছেন তখন BBC কিংবা CNN টিভি চ্যানেল চালু করে রাখবেন। খুব বেশি মনযোগ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করবেন কি বলা হচ্ছে। কিছুদিন পরেই দেখবেন ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
Public Speaking: Practice and Ethics বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে এ বিষয়ে চমৎকার আলাপ তুলে ধরেছেন আমেরিকার স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক Jason et al.
“আপনি অন্যদের মনোযোগ দিয়ে শোনার ফলে আরও বেশি করে বুঝতে শুরু করেন কিভাবে লোকেরা যুক্তি তৈরি করে এবং তথ্য উপস্থাপন করে। এর ফলে, কার্যকর ও অকার্যকর বিষয়বস্তু নিয়ে আপনি বিশ্লেষণ করতে পারেন, ফলশ্রুতিতে আপনার নিজের বক্তব্যগুলো উন্নত করতে পারেন”
তৃতীয় ধাপ- অডিও রেকর্ডিং: আমাদের সবার হাতেই এখন স্মার্টফোন আছে। যা একটি চমৎকার টুলস হিসেবে আপনাকে সহায়তা করতে পারে। আপনার চিন্তায়র্যো বিষয়গুলো আসছে সেগুলো একটু গুছিয়ে নিন। হাতের কাছে স্মার্টফোনের অডিও রেকর্ডিং অপশন চালু করে কথা বলতে শুরু করুন।নিজে একা একা অডিও রেকর্ড করুন। লাগাতার এক সপ্তাহ প্রতিদিন যেকোন বিষয়ে একটা বা দুইটা অডিও রেকর্ড করবেন। এক্ষেত্রে চাইলে কোন বিষয় বই থেকে দেখে নিতে পারেন পূর্বে অথবা মুখস্থ বিষয় ও না দেখে বক্তৃতার ধাঁচে রেকর্ড করবেন। সপ্তাহ পরে সেগুলো প্রথমটা থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে পরেরগুলো শুনবেন। এই ধাপে আরও একটা কাজ খুব সচেতনতার সাথে করতে হবে আর তা হল - মূল্যায়ন। অডিও শুনবেন ও খাতা কলম নিয়ে লিখতে থাকবেন যে, নিজের কাছে কোথাও কোন ঘাটতি মনে হচ্ছে কি না? প্রথম দিনের চেয়ে পরের অডিওগুলোতে নিজে কোন উন্নতি বুঝতে পারছেন কি না? এভাবে কিছুদিন অডিও রেকর্ডিং ও স্বনির্ধারনী মূল্যায়নের মাধ্যমে নিজেকে অনেকটা ভালো অবস্থানে খুঁজে পাবেন। Alsyouf 2021 সালে উনার এক গবেষণায় প্রমান করেন যে, বক্তৃতার ক্ষেত্রে অডিও/ভয়েস রেকর্ডিং নিম্নোক্ত উপায়ে একজন বক্তাকে উপকৃত করে থাকে - (ক) শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করে ও কথা বলায় সাবলীল গতি আনয়ন করে। (খ) বক্তব্য প্রদানে দক্ষতা বৃদ্ধি করে ও উদ্যম বাড়াতে সহায়তা করে। (গ) শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
চতুর্থ ধাপ- ভিডিও রেকর্ডিং: তৃতীয় ধাপ অর্থাৎ অডিও রেকর্ডিং করে ও মূল্যায়নের মাধ্যমে কিছুটা ধাতস্থ হলে পরবর্তীতে স্মার্টফোনের ভিডিও রেকর্ডিং অপশন চালু করে ভিডিও করবেন। এবং আগের ধাপে যেভাবে স্বনির্ধারনী মূল্যায়ন পদ্ধতির কথা বলেছি সেভাবেই অনুসরণ করবেন। আর প্রতিদিনের ভিডিও সেইদিন দেখবেন না। তাহলে আপনি আগ্রহ হারাবেন। একাদিক্রমে এক সপ্তাহ ভিডিও করার পরে একদিন বসে বসে সেগুলো দেখবেন ও মূল্যায়ন করে দূর্বলতা ও উন্নতি চিহ্নিত করবেন। রেকর্ডেড ভিডিওতে আপনার শারীরিক ভঙি, কথা বলার শরীরি ভাষা ও গলার কন্ঠস্বরের উঠানামা খেয়াল করবেন। আরও কি করলে ভাল হত সেগুলো নিজেই বুঝতে পারবেন। বিজ্ঞানী Cheng and Chau 2009 সালের এক গবেষণায় প্রমান করেন যে সাবলীল বক্তব্য দেওয়ার অভ্যাস করতে ভিডিও রেকর্ডিং চমৎকার ও কার্যকরী একটা মাধ্যম যার শিক্ষার্থীগণ তাদের বক্তব্যের গুনগত মান যাচাই করতে সম্ভব হয় ও উন্নতির চেষ্টা করতে পারে।
পঞ্চম ও শেষ ধাপ- আয়নার সামনে কথা বলা: যদিও এইটা সবশেষে লিখছি কিন্তু উপস্থাপনা কিংবা বক্তৃতা অভ্যাসের জন্য এইটিই প্রাচীনতম পদ্ধতি। যারা শিখে বক্তব্য বা বক্তৃতা করতে চান তারা প্রায় সকলেই এই পদ্ধতিতে নিজেকে যাচাই করে নিয়েছেন এ কথা বলাই যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়েই কথা বলবেন যত লম্বা সময় ধরে চালিয়ে যেতে পারেন। ভাববেন যে, একটা বক্তব্য দিচ্ছেন। নিজের মুখভঙ্গি , শারীরিক অঙ্গভঙ্গিও খেয়াল রাখবেন। পূর্বে রেকর্ডেড ভিডিও করে ও মূল্যায়ন করে যেসকল বিষয় উন্নতির কথা ভেবেছিলেন এখন আয়নার সামনে কথা বলতে সেগুলো শুধরিয়ে নিয়েছেন কিনা খেয়াল করবেন। এছাড়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে গেলে আপনি পুরো শরীরের ভাষা তাৎক্ষণিক অনুধাবন করতে পারবেন। অনেকেই বক্তব্যের মাঝে এতবেশি হাত নাড়াতে থাকেন যা দর্শকদের জন্য বিরক্তির উদ্রেক করে। আবার মূর্তিমান হয়ে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থেকে হাত দুটো শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে কথা বলেন যা মোটেও একজন ভাল বক্তার পরিচয় বহন করে না, দেখেই মনে হয় যে আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে। আবার কেউ একটা হাত একইভাবে একটু উপরে তুলে শুধু একইভাবে সামনে পিছনে করতে থাকেন যেইটা পুতুলের মত বা পাপেট সদৃশ মনে হয়। আয়নায় নিজের চোখের দিকেই নিজে তাকিয়ে কথা বলার অভ্যাস করুন। তাহলে দর্শকের দিকে বিভিন্নজনকে দৃষ্টি সংযোগে আনতে সুবিধা হবে।
আপাতত কথা বলার সময় সোশাল এংজাইটি কিংবা ফিয়ারনেস কাটানোর ব্যাপারে প্রাথমিক তবে খুব বাস্তবধর্মী কিছু পরামর্শ রইলো।
সফলতার কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা নেই। যেকোন বিষয়ে সফল হতে হলে সাধনার বিকল্প নেই। তাই লেগে থাকুন। উপরোক্ত ধাপগুলো ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করুন। আশা করা যায় আপনিই একদিন নিজেকে অনন্য বক্তা হিসেবে মেলে ধরতে পারবেন দেশ ও দেশের বাইরে। ইনশাআল্লাহ।
রেফারেন্সঃ (১) আল কুরআনঃ সূরা ৫৭ ও আয়াত ০৪; (২) আল কুরআনঃ সূরা ২০ ও আয়াত ২৫-২৮; (৩) Jason et al. Public Speaking: Practice and Ethics, p. 76; (৪) Alayoif 2021, The effect of voice recording as a tool to improve speaking skills, Runas Journal of Education and Culture,, vol. 5, 2021.
লেখক: এস.এম. আবু নাছের (ব্যাংকার, গবেষক ও লেখক)