উপকূলীয় অঞ্চল বরগুনার পাথরঘাটার অধিকাংশ মানুষ মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। মাছ শিকার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বেঁচে থাকার তাগিদে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রতিনিয়ত সমুদ্রে পাড়ি জমাতে হয়। এই সকল জেলেরা মাছ শিকার করতে গিয়ে সমুদ্রের প্রতিনিয়তই সম্মুখীন হয়েছে সাইক্লোন, বন্যা, সুনামি ও জলোচ্ছ্বাসের। মাছ শিকারে গিয়ে এই সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই ৩০ বছরে পাথরঘাটার ১৮৮ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন। ১৯৯৩ সালের বন্যা, ২০০৭ সালে সিডর, ২০০৮ সালে নার্গিস, ২০০৯ সালের আইলা, ২০১৩ সালে মহাসেন, ২০১৫ সালের কোমেন, ২০১৬ সালের রোয়ানু, ২০১৭ সালের রোমা, ২০২৩ সালের মিধিলিসহ এই সকল বন্যায় জেলে পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বেশি সংখ্যক জেলে ২০০৭ সালের সিডরে নিখোঁজ হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ৫, ১৯৯৪ সালে ২, ২০০১ সালে ৫, ২০০৬ সালে ১৪, ২০০৭ সালে ৯১, ২০১৪ সালে ৭, ২০১৮ সালে ১৩ ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে ১৫ জন জেলেসহ এখনো পর্যন্ত মোট নিখোঁজ রয়েছে ১৮৮ জেলে।
জেলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের স্বজন হারিয়ে বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। নিখোঁজদের কোনো মৃত্যু সনদ না থাকার কারণে পরিবারের জমি জমা বিক্রি সহ বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় পড়ছে পরিবারগুলো। নিখোঁজ জেলেদের স্ত্রীরা পাচ্ছে না সরকারি সহায়তার বিধবা ভাতা।
১৯৯৩ সালে নিখোঁজ কালমেঘার জেলে হারুন সরদারের মা জবেদা বলেন, আমার ছেলে একটি ট্রলারে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যায়। ঝড়ের কবলে পড়ে ট্রলারটি সমুদ্রে ডুবে যায় আমার ছেলে বেঁচে আছে, না মরে গেছে তাও জানি না। আমার ছেলে নিখোঁজের পর তার স্ত্রী ২ সন্তানকে রেখে ২ মাস পর বাবার বাড়ি চলে যায়। অন্যের বাড়ি কাজ করে আমি এই ২ সন্তানকে খাবারের ব্যবস্থা করি। এখন তারা কর্মের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম রয়েছে। ৩০ বছর নিখোঁজ থাকার পরেও পাইনি সরকারি কোনো অনুদান।
২০১৪ সালে স্বামীসহ ২ সন্তানকে হারিয়েছে চরদুয়ানীর রানী বেগম। তিনি বলেন, আমার স্বামী ইসমাইল ফরাজীকে হারিয়েছি সাথে ২ ছেলে সাইকুল ও শহিদুলকে হারিয়েছি, এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে। জানি না তারা কোথায় আছে বেঁচে আছে না মরে গেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২ পত্রবধূ চলে যায় বাবার বাড়ি, বিয়ে হয়েছে অন্যত্র। আমি অন্যের বাড়িতে কাজ করে মানুষের কাছ থেকে চেয়ে মেয়ে রহিমাকে এসএসসি পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এযাবৎকাল সরকারি সহায়তা ২০০০ টাকা আর ৫ কেজি চাল পেয়েছে।
পাথরঘাটা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই মৎস্য পেশার সঙ্গে জড়িত। নিখোঁজ জেলেদের তথ্য সংগ্রহ করেছি। যে জেলে নিখোঁজের ৬ মাস শেষ হয়ে গেছে ওই সব জেলে পরিবারকে আমরা ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছি। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আর কিছু একটা করার চেষ্টা করব তাদের জন্য।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোকনুজ্জামান খান বলেন, নিখোঁজ জেলেদের নামসহ উপজেলা পরিষদের মধ্যে একটি ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে দেখলেই বোঝা যায়, যেন এই উপজেলার কতজন জেলে নিখোঁজ। নিখোঁজ জেলেদের তালিকা প্রস্তুত করে রেশন ও আর্থিক সহায়তাসহ তাদের জমিজমা বিক্রির জন্য একটি সনদ দেয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাবর।
এইচএ