গত ২৩ অক্টোবর সিরাজগঞ্জ সদরের নলিছাপাড়ায় অবস্থিত এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীর অফিসে মৃত্যু হয় একই এলাকার হাজী আব্দুর রহিম ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মো. আশফাকুল আউয়ালের (৩৫)। এ ঘটনায় এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীর মালিক বিপ্লব রহমান মন্ডলকে (বাবু মন্ডল) এক নম্বর আসামি করে এজাহারনামীয় পাঁচজনসহ অজ্ঞাতনামা আরও তিন-চারজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর থানায় মামলাটি করেছেন মৃতের বড় ভাই রাকিবুল হাফিজ খান। এতে মাসুমপুর উকিলপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী দেওয়ান শহিদুজ্জামান শুভকে দ্বিতীয় আসামি করা হয়। সেই মামলায় পুলিশ তাকে পরদিন গ্রেফতার দেখিয়ে সাত দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। যদিও রিমান্ডে 'আশফাক হত্যা' সম্পর্কিত চমকপদ এমন কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি। পরে রিমান্ড শেষে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।
এদিকে শুভ'র বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী ও পরোপকারী একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার মতো এমন গুরুতর অভিযোগ কেউ মানতে পারছেন না। ফলে শুভ'র বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে এলাকাবাসী। একইসঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে যারা নিরাপরাধ মানুষকে হয়রানি করছে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
যদিও পুলিশ বলছে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও নিষ্ঠার সঙ্গে মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত আশফাকুল আওয়ালের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তদন্ত শেষ হলে ও মৃতদেহের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, 'গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী ইউনিয়নের নলিছাপাড়ায় অবস্থিত এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীর অফিসে আসেন হাজী আব্দুর রহিম ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মো. আশফাকুল আউয়াল। এসময় পাওনা টাকা নিয়ে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে কারখানার তিন মালিক আশফাকুল আউয়ালকে গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধে হত্যা করে।'
যদিও সময়ের কণ্ঠস্বরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্নতথ্য। মামলার এজাহারে কারখানার তিনজন মালিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সেখানে তিন নম্বর আসামি কামরুল ইসলাম তালুকদার (৫৫) উপস্থিতই ছিলেন না। শুধু তাই নয়, গত দুই-তিন মাস যাবতই কারখানাতে তিনি আসেন না বলে জানিয়েছেন আশেপাশের বাসিন্দারাও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীরে আটা ময়দা সরবরাহ করতেন একই এলাকার হাজী আব্দুর রহিম ফ্লাওয়ার মিলের মালিক মো. আশফাকুল আউয়াল। এতে করে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যবসায়ীক একটি সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নগদের পাশাপাশি বাকিতেও ময়দা সরবরাহ করায় সর্বশেষ তিন লাখ টাকার মতো পাওনা ছিলেন আশফাক। যা এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীর মালিকরা প্রতি সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করে আসছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় আশফাকুল আউয়াল এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীতে আসেন। এসময় কারখানায় অবস্থান করছিলেন দুই মালিক বিপ্লব রহমান মন্ডল, শহিদুজ্জামান শুভসহ কারখানার ম্যানেজার ও কর্মীরা। এসময় দেনা-পাওনা নিয়ে মালিক বাবু মন্ডলের সঙ্গে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে এগিয়ে গিয়ে শুভ দেখতে পান, আশফাক হঠাৎ করে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে। এসময় তাৎক্ষণিক আশফাকুলের মাথায় পানি ঢালেন শহিদুজ্জামান শুভ। এরই ফাঁকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন বাবু মন্ডল। পরবর্তীতে সুস্থতার জন্য আউয়ালকে নিকটস্থ আভিসিনা হাসপাতালে নিয়ে যান শহিদুজ্জামান শুভ। যা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বোন জামাতা ডাক্তার মোহসেনুল মোমিনকে মোবাইলেও জানান তিনি। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্তব্যরত ডাক্তার আশফাকুল আউয়ালকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে মৃত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ শহীদ এম. মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। এসময় তদন্তের স্বার্থে শহিদুজ্জামান শুভকে থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে শুভকে রাতভর থানায় আটকে রাখা হয় এবং পরদিন মৃত আশফাকের ভাইয়ের দায়ের করা হত্যা মামলায় শুভকে দ্বিতীয় আসামি করে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এঞ্জেল ফুডস্ এন্ড বেকারীর মালিক শহিদুজ্জামান শুভ'র ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আত্মীয় হচ্ছেন শহরের নতুন ভাঙ্গাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আশফাকুল আউয়াল। সেই সুবাধে ব্যবসায়ীক সম্পর্কের বাইরেও নিজেদের মধ্যে পারিবারিক একটা সুসম্পর্ক ছিল। ফলে ঘটনার দিন আশফাককে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন তিনি। যদিও পরে তাকেই করা হয়েছে মামলার দ্বিতীয় আসামি।
বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে কারখানার আশেপাশের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে সময়ের কণ্ঠস্বর। তাদের ভাষ্য, মৃত আশফাকুল আওয়াল যেমন একজন ভালো মানুষ ছিলেন, ঠিক তেমনই গ্রেফতারকৃত শহিদুজ্জামান শুভও। তাকে কোনোদিন কারো সঙ্গে বিবাদ তো দূরে থাক, উচ্চস্বরে কথা বলতেও দেখেননি তারা। তবে অপর মালিক বাবু মন্ডলের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন কেউ কেউ। তাই এ ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান তারা।
এদিকে ব্যবসায়ী শহিদুজ্জামান শুভকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শহরের চা স্টল থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে। তারা বলছেন, কারখানার মালিক হওয়াই কি অপরাধ শহিদুজ্জামান শুভ'র?। যে ব্যক্তি আশফাককে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন, হাসপাতালে নিয়ে গেলেন সেই কিনা হয়ে গেলেন হত্যা মামলার আসামি।
এলাকাবাসী আরও বলেন, মনগড়া একটি মামলায় আসামি হয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন নিরপরাধ ব্যক্তি ও একটি ভদ্র পরিবার। শুভ যদি হত্যার সঙ্গে জড়িতই থাকতেন, তাহলে তিনিও পালিয়ে যেতে পারতেন। কে জানত সরল মনে হাসপাতালে নিয়ে হত্যা মামলায় ফাঁসবেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জ সদর থানার এসআই মো. সোহাগ সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করা হচ্ছে। নিরপরাধ কাউকে যদি আসামি করা হয়, সেটা যাচাই-বাছাই হবে।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, চারদিনের রিমান্ড শেষে দ্বিতীয় আসামি শহিদুজ্জামান শুভ বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন, বাকি আসামিদের গ্রেফতারেও সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
এসময় পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে নিহত আশফাকুল আওয়ালের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নিও বলেও জানান এই কর্মকর্তা।