শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বিতরণের ধর্মীয় কোনো তাৎপর্য না থাকলেও এটি শত বছর ধরে সামাজিক রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিবেশীর সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক ও নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
শবে বরাত উপলক্ষে পুরান ঢাকার চকবাজারে বেচা কেনা চলে বুটের হালুয়া, মাস্কাট হালুয়া, মাখাদি হালুয়া, সুজির হালুয়া, গাজরের হালুয়া ও ফ্রেঞ্চি রুটির । প্রতিবছর পুরান ঢাকা জুড়েই আয়োজন হয় বলে জানান ক্রেতা-বিক্রেতারা।
জানা গেছে, এ দিনটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বেকারিতে তৈরি হয়েছে বাহারি নকশার পাউরুটি, সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের হালুয়া। হালুয়ার মধ্যে রয়েছে পেঁপে, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ডাল, ময়দা, সুজি, নেশেস্তা গাজরসহ বিভিন্ন প্রকারের হালুয়া।
বিক্রেতারা জানান, দামভেদে একেক হালুয়ার একেক দাম। বুটের হালুয়া বিক্রি হচ্ছে ৫শ টাকা কেজি। গাজরের হালুয়া ৬শ টাকা ও আর নেশেস্তাসহ অন্যান্য হালুয়ার কেজি ৮শ টাকা থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর ওয়ারীর বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, প্রতিবছর এদিনটি আমরা উৎসবের মতো করে পালন করি। ছোটবেলায় গ্রামে থাকাকালীন সময়ে এদিনে চালের রুটির সাথে হালুয়া নিয়ে মসজিদে যেতাম এবং সবাই মিলে নামাজের পরে সেগুলো বিতরণ করতাম। কিন্তু শহুরে জীবনে তো এটা কল্পনাও করা যায় না। তাই প্রতিবছর বিভিন্ন রকমের এসব রুটি হালুয়া দিয়েই সবাই মিলে শবে বরাত পালন করে থাকি আমরা।
বাঙালির উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ খাবার। আর মুখরোচক খাবার মানেই পুরান ঢাকা। উৎসবের কেন্দ্র পুরান ঢাকার মুসল্লিদের কাছে ঈদের পরই শবে বরাতের রাত অন্যতম। তাদের কাছে এই রাত উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে হালুয়া-রুটি। এ রাতের খাবার হিসেবে থাকে ঐতিহ্যবাহী নকশী রুটি বা ফেন্সি রুটি। যা রুমালি রুটি বা শবে বরাতি রুটি নামেও পরিচিত। বছরের এই একদিনই সাধারণত বিক্রি হয় বিশেষ এই রুটি।
পুরান ঢাকার চকবাজারের মূল সড়কের পাশাপাশি গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন রোড, লোহারপুল মোড়, নাজিরাবাজার, কলতাবাজার, নারিন্দা মোড়, বেগমগঞ্জ, সূত্রাপুর, মালিটুলা মোড়, রায় সাহেবের বাজারে শবে বরাতে সামিয়ানা টাঙিয়ে হালুয়া-রুটির বিকিকিনি হয়। এছাড়াও এ রাতকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী কনফেকশনারির দোকানগুলোতেও ফেন্সি রুটি বা নকশী রুটি পাওয়া যায়। এসব খাবারের ঘ্রাণ ও স্বাদ নিতে রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, গাবতলীসহ বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন ভিড় জমান।
শুক্রবার পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শবে বরাত উপলক্ষে ফেন্সি রুটি কেজিপ্রতি ১৫০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফুল ও মাছ আকৃতির বাহারি নকশায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ রুটি। শবে বরাতের দিনে পুরান ঢাকার প্রতি গলিতেই বিভিন্ন বেকারি কিংবা কনফেকশনারি সামনে ফেন্সি রুটির পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ফেন্সি রুটি দিয়ে খাওয়ার জন্য পাশাপাশি বিক্রি করা হয় বুটের ও গাজরের হালুয়া। হালুয়া বাটিপ্রতি ৩০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
প্রতি বছরের মতো এবারও পুরান ঢাকার অলিগলিতে দোকানিরা বিভিন্ন ধরনের রুটির পসরা সাজিয়ে বসেছেন। একেক রুটিতে একেক রকম নকশা করে তাতে বিভিন্ন কিছু ফুটিয়ে তোলা হয়। এগুলোর কোনোটা মাছের মতো, আবার কোনোটা কুমিরের মতো। এছাড়াও দোকানগুলোতে গোলাকার, নকশা করা এবং ফুলের আকৃতিতে বানানো অসংখ্য নকশার রুটি পাওয়া যায়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই ঐতিহ্য ধরেই ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে এই নকশা রুটি। শবেবরাতে এই রুটি আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হয়। বিশেষ করে শ্বশুর-শাশুড়িরা তার মেয়ে-জামাই বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই রুটি পাঠান।
গেন্ডারিয়া মোড়ে সামিয়ানা টাঙিয়ে খাবারের পসরা সাজিয়ে বসা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, রুটি তৈরিতে ময়দার সঙ্গে দুধ, ডিম, ঘি, কিসমিস, সাদা তিল ও কাজুবাদাম ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও হালুয়ার মধ্যে রয়েছে পেঁপে, চালকুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ডাল, ময়দা, সুজি, গাজরসহ বিভিন্ন প্রকারের হালুয়া।
ক্রেতারা জানান, শবে বরাত উপলক্ষে এ রুটি কেনার চল রয়েছে তাদের মধ্যে। পরিবার-পরিজন নিয়ে খাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী, আত্মীয়দের বাসায়ও পাঠানো হয় ঐতিহ্যবাহী ফেন্সি রুটি।
রায়সাহেব বাজারে কুসুম কনফেকশনারির মালিক আহমদ শরীফ জানান, শবে বরাত উপলক্ষেই আমরা বিশেষ ধরনের রুটি বানিয়ে থাকি। সকাল থেকে বিক্রি শুরু করেছি, বেচাকেনা ভালোই চলছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়তি, তারপরেও রুটির কেজি ক্রেতার নাগালের কাছাকাছি রাখা হয়েছে।