বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা ঘটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন, গত ৫ আগস্ট ২০২৪। সেদিন বিকেল গড়িয়েমাত্র আধা ঘন্টার ব্যবধানে একযোগে নগরীর একাধিক থানায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংস হয় ছয়টি থানা ও বেশ কিছু পুলিশ ফাঁড়ি, লুট হয় বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্রশাসনিক নথি, এজাহার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য ঘেঁটে এই ঘটনার ভয়াবহতা, লুণ্ঠিত অস্ত্রের বিস্তারিত হিসাব ও বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র উঠে এসেছে।
৫ আগস্ট বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে, নগরীর মোট ১৬ থানার মধ্যে ১০টিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে কোতোয়ালী, পাহাড়তলী, পতেঙ্গা, ডবলমুরিং, ইপিজেড ও হালিশহর থানায়। এসব থানার অস্ত্রাগার ভেঙে লুট করা হয় শত শত অস্ত্র, হাজার হাজার রাউন্ড গুলি ও কন্ট্রোল গিয়ার।
একই সময়ে বন্দর থানার হালিশহর ফাঁড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেখানে রাখা অস্ত্র ও গোলাবারুদও হামলাকারীদের হাতে যায়। এই ঘটনায় শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে।
ছয়টি থানায় দায়ের করা মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে রয়েছে – ৬৫টি ৯ এমএম তরাস পিস্তল (আমেরিকা ও ইতালি উৎপাদিত), ৪৬টি চায়না রাইফেল, ৯৫টি শটগান, ২৯টি সেভেন পয়েন্ট ৬২ পিস্তল, ১৭৬৩ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, ৩৮০০ রাউন্ড চায়না রাইফেলের গুলি, গ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড, গ্যাসগান, টিয়ার গ্যাস গ্রেনেডসহ অসংখ্য কন্ট্রোল অস্ত্র।
এছাড়া থানাগুলোতে সাধারণ মানুষের জমা রাখা বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রও লুট হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে একনলা বন্দুক, দু’নলা বন্দুক, রিভলবার, রাইফেল এবং বিপুল পরিমাণ কার্তুজ।
কোতোয়ালী থানার অস্ত্রাগারের তালা ও দেয়াল ভেঙে যেসব অস্ত্র লুট করা হয়েছে তা হলো – নাইন এমএম তরাস পিস্তল ২৩টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ৬৩টি, গুলি ৫৫৭টি, চায়না রাইফেল ৩টি, রাইফেলের গুলি ২৬৮ রাউন্ড, চায়না এসএমজি ২টি, ম্যাগাজিন ২টি, গুলি ৬০ রাউন্ড, ১২ বোর শটগান ১০টি, শটগানের কার্তুজ ২১৮২ রাউন্ড, শর্ট ও লং রেঞ্জ শেল ১০টি এবং সাউন্ড গ্রেনেড ১০টি।
গত বছরের ২২ আগস্ট ৪০ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) রিপন কুমার দাস।
পাহাড়তলী থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো হলো–নাইন এমএম তরাস পিস্তল ১০টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ২০টি, পিস্তলের গুলি ২০০ রাউন্ড, সেভেন পয়েন্ট ৬২ পিস্তল ১০টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ২০টি, গুলি ১৬০ রাউন্ড, চায়না রাইফেল ১৪টি, চায়না এসএমজি ৪টি, এসএমজি’র ম্যাগাজিন ১০টি, শটগান ৩০টি, শটগানের ম্যাগাজিন ১০টি, গ্যাসগান ৪টি, চায়না রাইফেলের গুলি ৫৬০ রাউন্ড, চায়না এসএমজি’র গুলি ৩০০ রাউন্ড, শটগানের রাবার কার্তুজ ৩৮৪ রাউন্ড, লেডবল কার্তুজ ১২০০ রাউন্ড, গ্যাস শেল লং রেঞ্জ ৬০টি, শর্ট রেঞ্জ ৪০টি, সাউন্ড গ্রেনেড ৪০টি, টিয়ার গ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড ৩৫টি, টিয়ার গ্যাস স্প্রে ২টি। এছাড়া থানায় সাধারণ মানুষের জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে ১০টি একনলা বন্দুক, সাতটি রিভলবার, পাঁচটি পিস্তল, একটি ২২ বোরের রাইফেল এবং ৩৬৮ রাউন্ড গুলি লুট করে হামলাকারীরা।
গত বছরের ২৪ আগস্ট ১৫ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে একটি মামলা দায়ের করেন এসআই এনামুল হক।
পতেঙ্গা থানা থেকে লুট করা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে–নাইন এমএম তরাস পিস্তল ৯টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ১৯টি, গুলি ১৭৯ রাউন্ড, সেভেন পয়েন্ট ৬২ পিস্তল ৭টি, ম্যাগাজিন ১৫টি, পিস্তলের গুলি ৯০ রাউন্ড, চায়না রাইফেল ১৫টি, রাইফেলের গুলি ৫১৩ রাউন্ড, চায়না এসএমজি ৬টি, এসএমজি’র ম্যাগাজিন ২৩টি, গুলি ৭২০ রাউন্ড, ১২ বোর শটগান ৩০টি, শটগানের ম্যাগাজিন ৯টি, কার্তুজ ১৩১৭ রাউন্ড, গ্যাসগান ৯টি, টিয়ারশেল লঞ্চার ৬টি, লং রেঞ্জ শেল ৭৫টি, শর্ট রেঞ্জ শেল ১১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ৪টি, টিয়ার গ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড ৮টি। এছাড়া সাধারণ মানুষের জমা রাখা বিভিন্ন ধরনের নয়টি বন্দুক ও গুলি লুট করা হয়েছে।
গত বছরের ২৪ আগস্ট ২৫ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করেন এসআই কেএম নাজিবুল ইসলাম তানভীর। এতে বলা হয়েছে, হামলাকারীরা থানার অস্ত্রাগার, এয়ারপোর্ট পুলিশ ফাঁড়ি, টানেলের নিরাপত্তা গার্ড, এসএফ-এর অস্ত্র ও গুলি লুট করে।
ডবলমুরিং থানা থেকে যেসব অস্ত্র লুট করা হয়েছে তা হলো–তরাস পিস্তল ১০টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ১১টি, গুলি ১০৯ রাউন্ড, চায়না এসএমজি’র গুলি ২২৫ রাউন্ড, শটগানের কার্তুজ ৮৯২ রাউন্ড, লং রেঞ্জ শেল ৪টি, শর্ট রেঞ্জ শেল ২টি ও টিয়ার গ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড ৬ রাউন্ড। এছাড়া সাধারণ মানুষের জমা রাখা চারটি পিস্তল, একটি একনলা ও একটি দু'নলা বন্দুক এবং ৯৪ রাউন্ড গুলি লুট করা হয়।
এ বিষয়ে গত ২৭ আগস্ট ১২ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন এসআই ইমাম হোসেন।
ইপিজেড থানার অস্ত্রাগার, সিইপিজেড ও নিউমুরিং পুলিশ ফাঁড়ি থেকে যেসব অস্ত্র ও গুলি লুট করা হয়েছে তা হলো–নাইন এমএম পিস্তল ৭টি, পিস্তলের গুলি ১৭৪ রাউন্ড, ম্যাগাজিন ১৭টি, সেভেন পয়েন্ট ৬২ পিস্তল ৬টি, গুলি ১১৯ রাউন্ড, ম্যাগাজিন ১৫টি, চায়না রাইফেল ১১টি, রাইফেলের গুলি ৪৩৬ রাউন্ড, চায়না এসএমজি ৪টি, এসএমজি’র গুলি ৩০০ রাউন্ড, ম্যাগাজিন ২৬টি, শটগান ৪৫টি, শটগানের কার্তুজ ৩১৭৮ রাউন্ড, গ্যাসগান ১২টি, গ্যাস শেল লং রেঞ্জ ১৪২ রাউন্ড, শট রেঞ্জ ১১৩ রাউন্ড, টিয়ারশেল ৬টি, সাউন্ড গ্রেনেড ১৯টি, গ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড ২০টি ও একনলা বন্দুক ১টি।
এ বিষয়ে গত বছরের ২২ আগস্ট অজ্ঞাতনামা ৩০ হাজার জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন এসআই শাকিলুর রহমান।
হালিশহর থানার অস্ত্রাগার থেকে লুট করা হয়–নাইন এমএম তরাস পিস্তল ৬টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ১২টি, পিস্তলের গুলি ৯৮ রাউন্ড, সেভেন পয়েন্ট ৬২ পিস্তল ৬টি, পিস্তলের ম্যাগাজিন ১০টি, পিস্তলের গুলি ৭৭ রাউন্ড, চায়না এসএমজি ১টি, শটগান ১টি, চায়না রাইফেলের গুলি ৯০ রাউন্ড, শটগানের কার্তুজ ৫১৮ রাউন্ড, গ্যাস শেল লং রেঞ্জ ১টি, সাউন্ড গ্রেনেড ২টি, টিয়ার গ্যাস হ্যান্ড গ্রেনেড ১টি।
এ ব্যাপারে গত বছরের ২৭ আগস্ট ১৬ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে হালিশহর থানায় মামলা করেন এসআই তৌফিকুল ইসলাম।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, লুট হওয়া অস্ত্রের একটি অংশ উদ্ধার হয়েছে। তবে এখনও অনেক অস্ত্র বাইরে রয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের ভৌগলিক অবস্থান ভিন্ন। এখানে পাহাড় আছে, সমুদ্র আছে, আবার প্লেন ল্যান্ডও আছে। এই ভৌগোলিক কারণে অস্ত্র উদ্ধার প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ছে। তারপরও চেষ্টা চলছে, নির্বাচনের আগেই আরও অস্ত্র উদ্ধার হবে।’
এই প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা সময়ের কন্ঠস্বরকে জানিয়েছেন, ‘আমরা বিভিন্ন সোর্স ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা করছি। তবে নির্বাচনের আগে যদি সব অস্ত্র উদ্ধার করা না যায়, তাহলে বড় ধরনের সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।’
লুণ্ঠিত অস্ত্রগুলো উদ্ধার না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক ও সাধারণ বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। নগরীর রাত যেন অনিশ্চয়তার আরেক নাম। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এক অদৃশ্য ভয় বিরাজ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব অস্ত্র নির্বাচনের সময় অপরাধী চক্র বা রাজনৈতিক সহিংসতায় ব্যবহার হলে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এসআর