টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে দাঁড়ালে চোখে পড়ে সরকারি ভবনের সারি, দপ্তরের ব্যস্ততা আর মানুষের যাতায়াত। দৃশ্যটা দেখে বুঝার উপায় নেই- এই প্রশাসনিক কোলাহলের আড়ালেই লুকিয়ে আছে বহু বছরের এক অস্বস্তিকর সত্য। উপজেলা পরিষদের প্রায় তিন বিঘা সরকারি জমি বহু আগেই বেসরকারি দখলে চলে গেছে, অথচ বিষয়টি নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ ছিল না কখনোই।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদের নামে মোট ৫৯৫.৯১ শতাংশ জমি নথিভুক্ত থাকলেও প্রায় একশ শতাংশ জমি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কোথাও দোকানঘর, কোথাও বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, আবার কোথাও রাজনৈতিক ছায়ায় গড়ে ওঠা বসতবাড়ি! এভাবেই দখলদাররা বহু বছর ধরে সরকারি জায়গা নিজেদের মালিকানা ভেবে ব্যবহার করে এসেছে।
বছরের পর বছর ইউএনও বদলেছে, প্রশাসনের কাঠামোও পাল্টেছে, কিন্তু জমি উদ্ধারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ ছিল না। বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব হাসান দায়িত্ব নিয়ে সেই চাপা নথিগুলো আবার খুলে দেখতে শুরু করেন। একে একে জমির ম্যাপ, দাগ, খতিয়ান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে জমি বেদখলের প্রকৃত অবস্থান।
পরে কাগজপত্রের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা মেলাতে তিনি সার্ভেয়ার ও ভূমি কর্মকর্তাদের নিয়ে মাঠে নামেন। দীর্ঘদিনের স্থবিরতা ভেঙে প্রথমবারের মতো সম্প্রতি আবার শুরু হয় সরকারি জমির সীমানা নির্ধারণের কাজ।
জানা গেছে, ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। তখন থেকেই ফসলান্দি ও ঘাটান্দি এই দুই মৌজায় মোট ২৪টি দাগে ৫৯৫.৯১ শতাংশ জায়গা পরিষদের নামে নথিভুক্ত ছিল। কিন্তু ‘নথি’ আর ‘মাঠের বাস্তবতা’ যে এক নয়, তার প্রমাণ মিলেছে এবারের পরিমাপেই।
একজন স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, 'এতোদিন কেউ দেখেনি। যে যেভাবে পেরেছে জায়গা দখল করে নিয়েছে। এখন এই ইউএনও উদ্যোগ নেওয়ায় জানতে পারছি এসব জায়গার আসল মালিক সরকার।'

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস সূত্র জানায়, অনেক জমি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ দখলে রয়েছে। ইতিমধ্যে কাগজপত্র যাচাই, তদন্ত ও সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। ফসলান্দি মৌজার দুটি দাগে ৮ শতাংশ জমি পরিষদের মালিকানাধীন হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে। বাকি জমির উদ্ধারের কাজও চলছে।
সূত্র জানায়, এরইমধ্যে দখলদারদের মধ্যে দুইজন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রশাসনও তাদের স্বাগত জানিয়েছে।
এদিকে উদ্ধারকৃত জমি উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা হলে উপজেলা পরিষদের অবকাঠামো পরিকল্পনায় বড় পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। ইতোমধ্যে নতুন উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। কিন্তু জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে অডিটোরিয়াম, মডেল মসজিদ কিংবা আনসার ভিডিবির নতুন ভবন- কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মো চাঁদ মিঞা বলেন, উপজেলা পরিষদের জায়গা মানেই সরকারি স্বার্থ জরিত। সরকারি জমি বেদখলে রাখার কোনো সুযোগ নেই। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি দখলে থাকে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তা ছাড়তে না চায়, তাহলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারের দাবি জানাই। এতে আমরা সব ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।
উপজেলা প্রশাসনের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে সুজনের ভূঞাপুর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ কুমার দত্ত বলেন, সরকারি জমি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দখলে রাখা কখনোই উচিত নয়। উদ্ধারকৃত জায়গাগুলো জনকল্যাণে ব্যবহারের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেলিমুজ্জামান তালুকদার সেলু বলেন, সরকারি জমি উদ্ধার করার দ্বায়িত্ব সরকারেরই। প্রশাসন যদি নাগরিক হিসেবে আমাদের কাছে কোন সহযোগিতা চায় সেক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করব।
ভূঞাপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শাহআলম প্রামাণিক বলেন, উপজেলা প্রশাসনের স্থাপিত জায়গায় প্রশাসনের ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এর বাইরে যদি আরও কিছু জায়গা থেকে থাকে, সেটাও অবশ্যই উদ্ধার করা প্রয়োজন। বর্তমান প্রশাসনের উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তবে আগের প্রশাসন যে সীমানা প্রাচীর তৈরি করেছিল, সেখানে কিছু ত্রুটি রয়েছে। প্রশাসনের জায়গা ছাড়িয়ে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো মাহবুব হাসান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, কিছু অসাধু ব্যক্তি বহু বছর ধরে অন্যায়ভাবে সরকারি জমি ভোগদখলে রেখেছেন। আমরা একে একে সব জমি শনাক্ত করছি। বিষয়টি কারও বিরুদ্ধে অভিযান নয়, বরং সরকারি সম্পদের সঠিক মালিকানা নিশ্চিত করা।
তিনি বলেন, কাগজে-কলমে আমাদের প্রায় ৬ একর জায়গা থাকলেও সরেজমিনে ৪ থেকে ৫ একরের মতো পাওয়া যাচ্ছে। বাকি অংশ বাইরে পড়ে আছে। আমরা সম্পূর্ণ আইনানুগ প্রক্রিয়ায় এগোবো। কারও ব্যক্তিগত পরিচয় এখানে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে যদি কোনো আদালতের নির্দেশনা থাকে, সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হবে। কিন্তু সরকারি সম্পদ বাইরে পড়ে থাকা সমীচীন নয়। এটা পরিমাপ করে সরকারের জায়গা সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে এটাই আমাদের দায়িত্ব।
এসকে/আরআই