

ত্রয়োদশ শতকের ফার্সি কবি জালালুদ্দিন রুমি। কালক্রমে সুফি গুরু হয়ে ওঠা এই কবির জন্মস্থান নিয়ে মত পার্থক্য রয়েছে। তাঁর পুরো নাম জালাল আদ-দীন মুহাম্মদ রুমি বলখি। খোরাশানের বলখ শহরে জন্মেছেন বলেই তাঁর নামের সাথে ‘বলখি’ যোগ হয়েছে। জায়গাটি বর্তমান আফগানিস্তানে। তবে মতান্তরে বৃহত্তর বলখ অঞ্চলের বখশ নদীর তীরে অবস্থিত ‘ওয়াখশ’ গ্রামে তাঁর জন্ম, যেটি বর্তমানে তাজিকিস্তানে অবস্থিত।
রুমি শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, তিনি পশ্চিমাবিশ্বেও ব্যাপক জনপ্রিয়। ইশকের সাধনা যে রহস্যময়তার ঘোর তৈরী করে তাঁর কবিতার সেই ঘোরে এখনো; এই সাতশ বছর পরের আধুনিক মানুষও বুঁদ হয়ে থাকেন। কবিতাগুলো মূল ফার্সি থেকে ইংরেজী হয়েছে, সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য জালালুদ্দিন রুমির তিনটি কবিতা কাজী জহিরুল ইসলাম-এর অনুবাদে উপস্থাপন করা হলো।
|| তুমিই আনন্দ ||
হে ঈশ্বর, আমাদের কলুষিত চক্ষুগোলকের দৃষ্টি
ঝাপসা, প্রায়ান্ধ; স্ফীত আমাদের মোহান্ধ পাপের বোঝা
পূর্ব থেকে পশ্চিম অবধি ছড়ানো তোমার যতো সৃষ্টি
সর্বত্রই লুকিয়ে তুমি, আমাদের শুধু নিরন্তর খোঁজা।
সূর্যালোকের চেয়েও অধিক প্রোজ্জ্বল, জ্বলে আছো তুমি
এবং আমাদের চেতন সত্ত্বার অস্তিত্বের জীবন্ত বারুদ
তোমার স্পর্শেই বিকশিত হয় আদিগন্ত মনোভূমি
বিস্ফোরণের মতোই তোমার নামের কল্যাণী দরূদ
আমাদের ঘুমন্ত নদীগুলোকে করে তোলে স্ফীত।
তোমার অস্তিত্ব লুকোনো রয়েছে অতি সুকৌশলে
তোমার তাবৎ উপহার প্রকাশ্য এবং অবারিত।
আমরা তো কেবল তৃষ্ণার্ত পাথর সমুদ্রতটে দলে দলে
তুমিই রহমতের জলধারা, ভেজাও নিয়ত আমাদের
তুমি প্রবহমান বাতাস, আমরা তো ধূলিকণামাত্র
সকলেই দেখে নড়াচড়া, ওড়াওড়ি, ধুলিঝড়ের
অদেখা বায়ুর মতো প্রবাহিত তুমি অহোরাত্র।
তুমিই অদৃশ্য বসন্তের বায়ু, আমি দিগন্তের সবুজ বনানী
তুমি অন্তর্নিহিত শক্তি, আমি তো কেবল অসার হাত ও পা
তুমি উপস্থিত বলেই নড়ে ওঠে আমাদের হস্ত-পদখানি
আমি তো শুধুই কণ্ঠস্বর, তোমার জ্ঞানই অস্তিত্বে রোপা
আমাদের এই হাঁটাচলা বিশ্বাসেরই নিরন্তর প্রতিভূ
অনন্ত স্বাক্ষর সন্দেহাতীত তোমার অমোঘ অস্তিত্বের
আমি তো কেবলই এক প্রায়ান্ধ প্রদীপ, নিভু নিভু
তোমার স্পর্শেই জ্বলে উঠি নিয়ত, ঘোষণা করি বিজয়ের।
মাথার ওপর অহরহ বাসা বাঁধে সময়ের ধূলিকণা
মেঘের জেলাবি খুলে আকাশ দেখায় কী নিখুঁত তার পেট
তোমার এ দাস কি করে লিখবে বলো গুণের বর্ণনা?
আমার এ আত্মা হোক তোমার পায়ের নিচে বিছানো কার্পেট।
|| প্রেম ||
ঈশ্বরের রহস্যপুঞ্জের এস্ট্রোল্যাব হলো প্রেম
এ-প্রেম সে-প্রেম বলে তাকে তুমি করেছো অঙ্কিত
অলক্ষ্য অভীষ্ঠ তার বলে রাখি খোদার হেরেম
এ-প্রেম আরাধ্য সুলতান জেনো একথা নিশ্চিত।
এতো রং মাখো তুমি দিনরাত ইশকের গায়ে
তোমার সলজ্জ নতমুখ কেনো লুকাও গোপনে?
জিহ্বার ব্যাখ্যায় সব কিছু হয় স্পষ্ট ডানে-বাঁয়ে
প্রেমই মহিমান্বিত, অনুচ্চারিত শব্দ শ্রবণে।
তোমার কলমখানি ভেঙে যায়, ছিঁড়ে যায় খাতা
ব্যাখ্যায় নিমগ্ন কবি কত সহস্ত্র বিনিদ্র রাত
যেন বা কাদায় আটকে যাওয়া গাধার প্রপাত
সে-শুধু নিজেই পারে দিতে সঠিক পথের খোঁজ
যাকে তুমি প্রেম বলো যে এই পথের উদগাতা
সূর্য দেয় নিজে যথা নিজ অস্তিত্ব-প্রমাণ রোজ
স্পর্শ চাও যদি আরাধ্য ইশকের বুকের গভীরে
পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না কখনো তাকে উল্টো ফিরে।
|| সুন্দর, যে দেখেছে ||
ঈশ্বরের অনন্য সৃষ্টি, এক এস্ট্রোল্যাব, মানুষের মন
আকাশ-বিজ্ঞানীর অতি প্রিয় মহাকাশ রহস্য পরিমাপক যেমন
আলু-পেঁয়াজ বেপারীর হাতে যদি পড়ে
মহামূল্যবান এ যন্ত্র কোনো অবসরে
কী দশা হবে দেখেছো কি ভেবে? কী পাবে মুদি
গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথে ছড়ানো সময়ের রেখায়?
অজ্ঞতাবশত বরং সে বেঁচে দেবে আলুর দরে এ অরুন্ধুতি
যুগ যুগ ধরে যে তারাটি দিক-দিশা মানুষকে শেখায়।
কিন্তু এ লৌহখণ্ড পরশপাথর, কেবল তার হাতে
হোক না সে অন্ধ জ্যোতির্বিদ এক নির্জন রাতে
আদমের প্রতিভূ অগণিত মানব সন্তান
ঈশ্বরের এস্ট্রোল্যাব, করে অসীমের সন্ধান
অহরহ, প্রোথিত বুকের আয়নাতে
প্রতি পলে, প্রতি বিন্দু ফলিত আলোর কণাতে
অনন্ত অসীম তার রূপের বাহার
সে-ই শুধু দেখে, আছে যার দৃষ্টি দেখার।