

আশরাফুল ইসলাম রনি, তাড়াশ প্রতিনিধি: চলনবিলে এখন মাছ ছাড়াও ধান, সরিষা, রসুনের পাশাপাশি সরিষা ফুল থেকে মধু উৎপাদনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠে এখন সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠ জুড়ে হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মধু উৎপাদনে চলন বিলে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলতি মওসুমে চলনবিল অঞ্চল থেকে প্রায় দেড় হাজার টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মৌ-চাষিরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। চলনবিল অঞ্চলের তাড়াশ, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, চাটমোহর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবি জাতের সরিষা চাষ হয়েছে।
চলনবিল অঞ্চলের তাড়াশ উপজেলার ধাপ-তেতুলিয়া গ্রামের কৃষক সায়েম আহম্মেদ জানান, প্রতিবিঘা জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভাল ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মণ সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মণ সরিষা বাজার মূল্য এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়।
এ অঞ্চলে সরিষা আবাদ বৃদ্ধি সাথে সাথে বেড়েছে মৌসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল ও খৈল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈব সার। খৈল ব্যবহার করা হয় গবাদি পশুর খাদ্য ও মাছের খাদ্য হিসেবে। ফলে কৃষকরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
চলতি মৌসুমে যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে তাহলে চলনবিল থেকে এক হাজার পাঁচশ থেকে এক হাজার ছয়শ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানালেন উত্তরাঞ্চল মৌচাষী সমিতির সভাপতি মোঃ জাহাঙ্গীর আলম। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা হিসেবে ২০ থেকে ২২ কোটি টাকা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌ চাষিরা সরিষা ক্ষেতের পাশে ৪৫ থেকে ৫৫ হাজার মৌ বক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌ চাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডঃ তাহমিনা হক জানান, অতীতকাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে।
তাড়াশ উপজেলার জলিলনগর গ্রামে অবস্থিত আল্লাহর দোয়া নামক মৌ-চাষি ও মধু সংগ্রহের সত্বাধিকারী আব্দুল মস্তফা জানান, সরিষার জমির পাশে মৌ বাক্স থেকে মৌমাছি ছেড়ে দেয়া হয়। মৌমাছির দল সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ করে বাক্সে থাকা মৌচাকে এসে মধু জমা করে। পরে তারা সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করেন। বর্তমানে প্রতিমণ মধু বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা করে। তবে এ বছর চলনবিল এলাকায় সরিষার আবাদ একটু কম হয়েছে। এ জন্য হয়তো গত বছরের তুলনায় মধু সংগ্রহ কম হবে বলে জানান। ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ৫ শতাধিক মৌ-চাষিরা হাজার হাজার মৌ-বাক্স ফসলি মাঠে স্থাপন করে মধু সংগ্রহে নেমে পড়েছেন।
এ ব্যাপারে তাড়াশ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম সময়ের কণ্ঠস্বরকে জানান, চলনবিল এলাকার বিস্তৃীন মাঠ জুড়ে সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। আর এখানে মধু চাষিদের প্রশিক্ষনের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। আশা করছি আবহাওয়া অনুকুল ভাল থাকলে সরিষার ফলন ভালো হবে ও মধু সংগ্রহ করতে পারবে মধু চাষিরা।