

চিত্র-বিচিত্র ফিচার ডেস্ক-সময়ের কণ্ঠস্বর-
ভারতে সমলিঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক সম্পুর্ন অবৈধ। একইসাথে সমলিঙ্গের যুগলদের পশ্চিমা দেশের মত একসাথে বসবাস কিংবা বিয়ে করার অনুমতি নেই কোন আইনেই ।২০১৩ সালে সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে বলেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। যতক্ষণ না সংসদ আইন করে এই ধারা লোপ করছে ততক্ষণ সমকামিতা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
এমন আইনকে ‘বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে গত কদিন ধরেই মিডিয়া জুড়ে তোলপাড় চলছে দুই সমকামী ভারতীয় নারীর বিয়ের গল্প!
ভারতের পাঞ্জাবে একজন অর্ধবয়স্কা মহিলা সরকারি কর্মী তারই অফিস সহকারী এক যুবতী সঙ্গীনীর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। তবে এর চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হলো কোন রকম রাখ ঢাক ও গোপনীয়তার তোয়াক্কা করেননি তারা। বেশ ধুমধামের সাথেই বিয়ে হয়েছে দু নারীর!
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমসহ বিশ্বগনমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সুত্রমতে পাঞ্জাব রাজ্য সরকারের ওয়ার্ডেন পদে কর্মরত মনজিৎ কাউর সান্ধু (৪৪) বছর বয়স্কা এক নারী বিয়ে করেছেন ২৭ বছর বয়সী যুবতীকে।
বিয়ের সময় আত্মিয়-স্বজন ও সহকর্মীদের এই যুগল জানিয়েছিলো, তারা স্রেফ একসাথে থাকতে চায়, কারন দুজনের পারস্পরিক মানসিক সমঝোতা ঠিক আছে। এর পেছনে ‘যৌনতা’ বা সমকামীতা বলেও কিছু নেই।
তবে এই যুগল এমন দাবী করলেও বিয়ের কদিন পরেই জানা গেলো তাদের এমন বিচিত্র বিয়ের পেছনের রহস্য। ভারতীয় একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সুত্র বলছে, ৪৪ বছর বয়সী মনজিৎ নামের ঐ নারীর ডিভোর্স হয়েছিলো বছর ৩০ এর সময়। পরিবারে স্বামীর সাথে নিত্যকলহ থেকেই ঐ ডিভোর্সের সুত্রপাত। মনজিত নিঃসন্তান ছিলেন। এরপর থেকেই পুরুষের প্রতি একধরনের বৈরাগ্য কাজ করতে শুরু করে তার । একা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, ব্যস্ত হয়ে যান চাকুরীজীবনে।
অন্যদিকে, মনজিতের বান্ধবী (হিন্দুধর্মমতে বিয়ের পর স্ত্রী ) উপমার কৈশর জীবনেই প্রেম ও পরে বিয়ে হয়েছিলো। কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হয় নানা দ্বন্দ্ব। জীবনে অতিষ্ঠ উপমাও ডিভোর্স নেন স্বামীর কাছ থেকে । উপমার বয়স তখন ২৬ । এরপর চাকুরীতে এসে পরিচয় হয় মনজিতের সাথে। বয়সে দুজনের ফারাক থাকলেও জীবনের কোনসন্ধিক্ষনে মিলে যায় দুজনের ভাবনা।
দুজনের পারিবারিক সুত্র জানিয়েছে, ব্যক্তিজিবনে পুরুষদের প্রতি এই দুজনের প্রকট আকারে বিদ্বেষ ছিলো। একসাথে চাকুরীর সুবাদে দুজনের সখ্যতা বাড়তে থাকে। কোনদিন কেও অবশ্য এ নিয়ে ভাববার অবকাশ পাননি যে তারা গিয়ে একসময় এমন ‘মহাকান্ড’ ঘটিয়ে ফেলবেন! তাছাড়া দুজন নারীর একসাথে থাকা চলাফেরা আন্তরিকতাকে কেই বা সন্দেহের চোখে দেখে এই সমাজে?
মনজিত ও উপমার ঘনিস্টসুত্র এই সমকামী দম্পত্তির উধৃতি দিয়ে বলেছেন, সমকামীতার বিষয়টা আসলে এখানে মুখ্য নয়! এই দুজন শুধুমাত্র পুরুষের প্রতি বিদ্বেষের কারনেই এমন অদ্ভুত বিয়ে করেছেন । দুই নারীর এমন অদ্ভুত বিয়ে পুরুষ সমাজের প্রতি একধরনের প্রতিবাদ মনে করছেন তারা।
ভারত যদিও , হিজড়াদের কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দেয় এবং তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ২০০৮ এর ২৯ জুলাই এ দিল্লী, কোলকাতা এবং ব্যাঙ্গালোরে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু সে আন্দোলন ধোপে টিকেনি সে দফায়।
এদিকে, এই বিয়ে নিয়ে মিডিয়াতে অনেক ভুল জিনিসও লেখা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন মনজিৎ সান্ধু । তিনি ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, “এগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনে অবাঞ্ছিত নাক-গলানো ছাড়া কিছুই নয়।” তা ছাড়া আমি কোনওদিন অপারেশন করিয়ে আমার লিঙ্গ পরিবর্তনও করাইনি।
তার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি বিষয় উল্লেখ করে মনজিত জানান, ” এটা নিয়ে এত হইচই করারও কিছু নেই। তাদের দুই পরিবারের সদস্যদেরই এই বিয়েতে সমর্থন ছিল এবং তারা সবাই বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন’
এর আগে গত সপ্তাহে পাঞ্জাবের জলন্ধর শহরের পাক্কা বাগ এলাকায় একটি মন্দিরে হিন্দু রীতিনীতি অনুযায়ী এই বিবাহ অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয় বলেও জানা গেছে। ধর্মীয় রীতি অনুসারে বিয়ের পর শহরের একটি হোটেলে নবদম্পতির সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। তাতে তাদের পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরাও হাজির ছিলেন।
মনজিৎ এরপর লাল পাগড়ি পরে ও ঘোড়ায় টানা রথে চেপে ‘নববধূ’কে নিয়ে তার বাড়িতে এসে ওঠেন।
তবে এই বিয়ের ছবি ও ভিডিও কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে ঝড়ের বেগে। জলন্ধর-সহ গোটা পাঞ্জাবে এই বিয়ে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যেহেতু ভারতে সমকামি বিয়ের আইন নেই ,এবং এটি দন্ডনীয় অপরাধ সেহেতু এই আলোচিত বিয়ে দেশের আইনকে একপ্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখানোর সমান বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
সমকামী বিয়ের যতকথা
সমকামীতার ইতিহাস অনেক পুরাতন। বলা চলে এটা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসছে। এওকসময় এই উপমহাদেশেই দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের একটু রাখ ঢাক থাকলেও ক্ষমতাবান আর ধনীদের জন্য এটা ছিল উন্মুক্ত। ইতিহাস চষলেই মাত্র ৭০-৮০ বছর আগে বাংলাদেশের গ্রামেই “ঘেটু দল” ছিল। যেটা ছিল যাত্রা দলের মত নাচ গানের দল। এসব দলে একটি বালক থাকত যে মেয়েদের পোষাক পড়ে নাচ গান করত। এই দলটি অস্থায়ীভাবে জমিদারের বাসায় থেকে জমিদারের মনোরঞ্জন করত আর ওই বালকটি হত জমিদারের ভোগের উপকরন।
এ নিয়ে হুমায়ুন আহমেদের একটি সিনেমা আছে – “ঘেটুপুত্র কমলা”। সেই আমলে এমন প্রকাশ্য সমকামীতা এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে, আমাদের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম এক সময় এমন একটি দলের সাথে গান বাজনা করতেন (তথ্য – হুমায়ুন আহমেদ)। এখন যুগ পরিবর্তন হয়েছে। এখন সমকামীতা ক্ষমতাশীল ও ধনী দেশগুলোর জন্যই উন্মুক্ত। এসব দেশের সমকামীতায় বৈধতার পেছনে ব্যাবসা একটা বড় কারন।
আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের আদালত সমকামী বিয়ের পক্ষে রায় দিয়েছিলো । এই রায়ের পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম সমকামী বিয়ে হয় ২০০৪ সালে। এরপরই সেখানে সমকামীদের বিয়ের প্রচলন শুরু হয়। তবে নানা বাঁধা বিপত্তির মুখেই পড়েছিলো এমন প্রশ্নবিদ্ধ বিয়ে।
অতঃপর নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৫ সালে বিচারক অ্যান্থনি কেনেডি এক বাদীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘আইনের চোখে সবার মর্যাদা এক। সংবিধান সবার অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে।’
ততকালীন যুক্তরাস্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বলেন, ‘যখন যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিকদের সমান চোখে দেখা হবে তখনই আমরা অনেক বেশি স্বাধীন হব।’
সুপ্রিম কোর্ট মিশিগান, ওহাইও, কেন্টাকি ও টেনেসি অঙ্গরাজ্যগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সেসময় এই আদেশ দেন । তবে এসব অঙ্গরাজ্যে সমলিঙ্গের বিয়ের ওপর কড়াকড়ি বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দেশের সংবিধান এমন নিষেধাজ্ঞাকে অনুমোদন করে নাসমকামীরা যেখানেই বাস করুক না কেন, তাঁদের বিয়ে করার অধিকার আছে।