

সময়ের কণ্ঠস্বর ডেস্ক- হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড মোড় থেকে শিমরাইল মোড় এলাকায় দিনভর তাণ্ডব চালিয়েছে হরতাল সমর্থকরা।
এই এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে একের পর এক, পোড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি। হামলা থেকে বাদ যায়নি অ্যাম্বুলেন্সও। রোগী বহনকারী প্রাইভেট কারকেও ছাড় দেয়া হয়নি। গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে আরও ব্যাপক। ‘সঠিক নিউজ প্রচার হচ্ছে না’ দাবি তুলে সাংবাদিক দেখলেই হামলে পড়েছে হেফাজতকর্মীরা।
রোববার (২৮ মার্চ) ভোর থেকে সেখানে উপস্থিত ছিল পুলিশ, বিজিবি। হেলিকপ্টারে টহল দিয়েছে র্যাবও। কিন্তু হেফাজত সমর্থকদেরকে তারা মহাসড়ক থেকে সরাতে পারেনি।
এদিন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে দৈনিক সংবাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি সৌরভ হোসেন সিয়াম লাঞ্ছিত হয়েছেন। সিয়ামের অভিযোগ, সৌরভ নাম বলায় হেফাজত কর্মীরা তাকে মারধরের পর চার কালেমা পাঠ করিয়ে মুসলিম ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করে।
রোববার (২৮ মার্চ) রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট দিয়ে এসব অভিযোগ করেছেন সিয়াম। তিনি একইসঙ্গে প্রথম আলো বন্ধুসভা নারায়ণগঞ্জের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক।
প্রথম আলো’র নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা গোলাম রাব্বানী শিমুল বলেন, ‘সৌরভের সঙ্গে আজ এ ঘটনা ঘটেছে। এখন সে অসুস্থ অবস্থায় বাসায় আছে।’
সিয়াম ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘রোববার দিনভর সংবাদকর্মীদের প্রতি হিংস্রতা দেখিয়েছে হেফাজতের হরতালে থাকা পিকেটাররা। হেফাজতের হামলার শিকার আমি সৌরভ হোসেন সিয়াম নিজে। তাদের কাছে আমার পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়েছে। চার কালেমার দুই কালেমা মুখস্থ বলতে হয়েছে। কয়টা সুরা মুখস্থ তা জানাতে হয়েছে।
নামের একটা অংশে সিয়াম (তাদের মতে সৌরভ হিন্দুয়ানী নাম) থাকাতে তাদের স্বস্তি হয়েছে… বিশ থেকে বাইশ মিনিট একটা গাছ কাটার করাত কলে অবরুদ্ধ ছিলাম। চারদিকে ঘিরে ছিল দাড়ি-টুপিওয়ালা তৌহিদি জনতা (হ্যাঁ, আমি তাদেরকে এভাবেই চিহ্নিত করতে চাই) প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পেরেছি এটাই অনেক।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘শরীরে ভয়ানক ব্যথা নিয়ে বিছানায় পড়ে আছি। পাশেই কোনো এক মাহফিল থেকে বলছে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। হ্যাঁ, বোধ হওয়ার পর থেকে এমনটাই শুনে আসছি। তাহলে দুপুরে নারায়ে তাকবীর বলে যারা আমাকে পেটাল তারা কি শান্তির বার্তাবাহক!’
পরে রোববার রাতে সিয়াম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুপুরে মাদানীনগর মাদ্রাসার সামনে হেফাজত কর্মীরা যখন বিক্ষোভ করছিলেন, তখন আমি ভিডিওধারণ করতে থাকলে তারা আমাকে ধরে মারধর শুরু করেন। সেসময় তারা আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আমি সংক্ষেপে শুধু ডাক নাম “সৌরভ” বলি। এতেই তারা আমাকে হিন্দু মনে করে ব্যাপক মারধর করেন। কালেমা পাঠ করার পরও ২০ মিনিট আমাকে আটকে রাখেন। অন্য সাংবাদিকরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ কিনেছি। গায়ে এখন জ্বর আছে।’
হেফাজতের তান্ডবের দিন শুধু সাংবাদিক সৌরভ হোসেন সিয়াম নয়, সংবাদ সংগ্রহের কাজে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অন্তত ২০ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। ছবি নিতে গেলে বা পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় একের পর এক হামলার শিকার হয়েছেন তারা।
শিরাইরাইলের কাছাকাছি জায়গায় হামলার শিকার হন নিউএইজের সাংবাদিক মোক্তাদির রশিদ রোমিও। তার সঙ্গে ছিলেন আরটিভি অনলাইনের একজন সাংবাদিক। দুজন মহাসড়ক ধরে যাওয়ার পথে তাদের আটকায় কয়েকজন পিকেটার। পরিচয়পত্র দেখানোর পর তাদের ছাড়া হয়নি।
‘সঠিক নিউজ প্রচার হচ্ছে না’ দাবি করে রোমিও মাথায় বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। হেলমেট মাথায় থাকায় রোমিও খুব একটা আঘাত না পেলেও তার হেলমেটটি ভেঙে গেছে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেসরকারি টেলিভিশন নিউজ টোয়েন্টিফোরের একটি গাড়ি সানারপাড় মোড়ের কাছে দাঁড়ানো ছিল। পিকেটাররা চালককের মারধর করে গাড়ির চাবি রেখে দেয়। এরপর গাড়িটি ভেঙে চুরমার করা হয়।
এক পর্যায়ে পিকেটারদেরই একজন গাড়িটি চালিয়ে রাস্তায় মাঝখানে নিয়ে আসে জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য। এ সময় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দুজন সাংবাদিক পিকেটারদের দিকে এগিয়ে যান। তাদের অনুরোধে গাড়িটি না জ্বালিয়ে চাবি ফিরিয়ে দেয় পিকেটাররা।
সাইনবোর্ড এলাকায় ছবি তুলতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোরের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি বিল্লাল হোসাইন। তার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিয়ে যায় পিকেটাররা। এরপর ওই এলাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সড়ে আসেন তিনি।
গাড়িতে আগুনের ফুটেজ নেয়ার সময় মারধরের শিকার হয়েছেন জিটিভির ক্যামেরাপারসন মাসুদুর রহমান। মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছেন তিনি।
মূল সড়ক ধরে সানারপাড় বাসস্ট্যান্ড থেকে মৌচাকের দিকে যাওয়ার পথে বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক এম কে রায়হান ও বৈশাখী টেলিভিশনের আশিক মাহমুদ। ধাওয়া করে তাদের মারধর করে হরতাল সমর্থক একদল যুবক। ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ফোন।
উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ এবং এর জেরে সংঘর্ষের তৃতীয় দিনেও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। হতাহতের প্রতিবাদে গতকাল রোববার হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজপথ উত্তপ্ত থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি তান্ডব চালানো হয়েছে।
হরতালকারীরা সেখানে সরকারি, বেসরকারি অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান, একটি মন্দির ও বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব ও হাইওয়ে থানা। হেফাজতের তান্ডবে শহরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরও তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে তিন দিনের সহিংস বিক্ষোভে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ জন এবং হাটহাজারীতে ৪ জন মারা গেছেন। তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে পুলিশ বা স্থানীয় প্রশাসন কিছু বলেনি। হাসপাতাল ও পারিবারিক সূত্র মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে হেফাজত দাবি করছে, ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।