

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় : খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠছে। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধীন ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক বিটপ শোভন বাছাড়ের বিরুদ্ধে এবার যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা ।
২২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময়ে এই শিক্ষক কতৃক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ এনেছেন ।
এরই মধ্যে প্রাথমিক তদন্তে এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে চিঠি দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সুত্রে জানা গেছে, ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের অভিযুক্ত শিক্ষক বিটপ শোভন বাছাড় বিভিন্ন সময় ডিসিপ্লিনের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়ন করে আসছিলেন।
এছাড়া ফিগার পেইন্টিং এর জন্য তিনি প্রায়ই নারী শিক্ষার্থীদেরকে আলাদাভাবে ডাকতেন মডেল হবার জন্য। আর তার প্রিয়পাত্র না হলে তিনি তাদেরকে একাডেমিকসহ কোন বিষয়েই তিনি সহযোগিতা করতেন না। হয় তাদের ফোন কেটে দিতেন অথবা রিসিভ করতেন না।
এছাড়া তার পছন্দের তালিকায় থাকা নারী শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্নভাবে নিজেকে গুরু মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করতেন এবং যেসব শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষকের শিষ্যত্ব গ্রহন করবে তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেবার প্রতিশ্রুতি দিতেন। তবে শুধুমাত্র ড্রয়িং ও পেইন্টিং শেখানোর মধ্যে এই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল না। যারা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করবে তাদেরকে নিজেদের বয়ফ্রেন্ডসহ সবকিছু ত্যাগ করতে বলতেন। আর তিনি দিনে হোক বা রাতে যখনি ডাকবেন দেখা করতে বলতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযোগকারী দ্বিতীয় বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে আলাদা দেখলেই উনি তাদেরকে বাসায় যাওয়া পর্যন্ত পিছু নিয়ে ব্যক্তিগত আলাপ শুরু করে দিতেন। এছাড়া উনি কাউকে আলাদা ডাকলে যদি কখনো তারা বন্ধু-বান্ধবী কাউকে সঙ্গে নিয়ে গেলে অভিযুক্ত ওই শিক্ষক দুইজনকেই অপমান করতেন। তিনি চাইতেন তার ডাক পাওয়া নারী শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করুক।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নাম্বার বণ্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্যের অভিযোগ রয়েছে। তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে ভালো সম্পর্ক রাখা শিক্ষার্থীদেরকে তিনি সবসময় বেশি নাম্বার দিতেন।
শিক্ষার্থীরা জানায়, তিনি সাধারণত তাদেরকে চাপে ফেলার জন্য প্রথম ধাপে সবসময় কম মার্কস দিতেন। পরীক্ষার খাতায় খারাপ করেও এরপরে শুধুমাত্র তার সঙ্গে আলাদা দেখা করতে গেলেই তিনি তাদের নাম্বার বাড়িয়ে দিতেন। নাম্বার বাড়িয়ে বলতেন বিগত দিনে তোমাদের পারফরম্যান্স ভালো তাই তোমাদের নাম্বার বাড়িয়ে দিলাম।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিটপ শোভন বাছাড় বলেন, তিনি এখনো অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত জানেন না। তিনি ডিসিপ্লিনের কিছু শিক্ষকের নোংরা রাজনীতির শিকার। এসময় তিনি অভিযোগপত্র হাতে পেলে সব বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে চান। আর গুরু শিষ্যত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন যারা অভিযোগ করেছে তারা আসলে এই টার্মটাই বোঝে না।
এদিকে, বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। যারা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারিরিকভাবে হয়রানি করছেন। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক শিক্ষার্থীই বিষয়গুলো প্রকাশ করেন না। অভিযোগ প্রকাশ করলে একাডেমিক ভাবে হয়রানির আশংকাও তারা করে থাকেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কিছু শিক্ষক আছেন, যারা কারণে অকারণে নিরিবিলি দেখা করতে বলেন। তাদের কক্ষে কখনো একা প্রবেশ করলে আপত্তিকর ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলেন। ক্লাসেও অনেক সময় অশ্লীল রসাত্মক কথা বলেন। সম্মানের ভয়ে আমরা প্রতিবাদ করি না। তাছাড়া শিক্ষকদের হাতে আমাদের বিষয় ভিত্তিক কিছু নম্বর থাকে, যে কারণে ভয়ে আমরা প্রতিবাদ করি না।
এদিকে গত বছরের ২৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের একজন নারী শিক্ষিকা তারই সহকর্মী একই ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক ছোটন দেবনাথের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলে জমা দেন।
তবে সাড়ে সাত মাস পেরিয়ে গেলোও এখনো শেষ হয়নি ছোটন দেবনাথের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের সেই তদন্তপ্রক্রিয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলের প্রধান প্রফেসর মোসা. তাসলিমা খাতুন বলেন, ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থীদের অভিযোগটি আমলে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি তদন্তাধীন হওয়ায় তিনি এ বিষয়ে আর কোন মন্তব্য করতে চাননি।
তিনি আরো বলেন, সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করার জন্যই গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ডিসিপ্লিনের ওই নারী শিক্ষকের অভিযোগ এখনো তদন্তাধীন রয়েছে।
এদিকে অপ্রীতিকর এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিব্রত বলে জানান ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস। তিনি বলেন, সব কিছু সুচারুভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। সর্বশেষ অভিযোগ পাওয়ার পর ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক বিটপ শোভন বাছাড়কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন জানান, শিক্ষকরা হচ্ছেন সমাজের আদর্শ। তারা বিচ্যুত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে গোটা সমাজে। সেক্ষেত্রে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।
প্রসঙ্গত, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনা নতুন কিছু নয়। গত বছর ২৬ আগস্ট গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক ছোটন দেবনাথের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেন তারই এক নারী সহকর্মী। ৬০ কার্যদিবসে তদন্ত শেষ করার বিধিবিধান থাকলেও সাত মাস পার হয়ে গেছে কিন্তু এখনো কাজ শেষ করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।
দু’ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ডিসিপ্লিনের শিক্ষক মীর সোহরাব হোসেন সৌহার্দ্যর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল। ওই সময় পত্রপত্রিকায় বিষয়টি ফলাও করে প্রকাশ হয়।
২০১৭ সালে নিজ ডিসিপ্লিনের ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. শরীফ উদ্দিনকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
২০১২ সালে অর্থনীতি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক ড. সাইফুল ইসলাম, ২০১৩ সালে বাংলা বিভাগের আনিসুর রহমান, ২০১৬ তে অ্যাগ্রো ডিসিপ্লিনের আমিনুল ইসলামকে যৌন হয়রানির অভিযোগে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।