অসীম কুমার সরকার, রাজশাহী প্রতিনিধি: দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার (০২ ফেব্রুয়ারি), তখন বেলা ১১টা। সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ায় আদালত অঙ্গনে বিচার প্রার্থীদের উপস্থিতি ছিল বেশ। প্রতিটি আদালতের সামনেই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিচার প্রার্থীদের।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ২ আদালতে বিচারক মাসুদুজজামান (মির্জা মাসুদ) একটি যৌতুকের মামলায় জামিন শুনানিকালে ছোট্ট শিশুর কান্নার আওয়াজ দৃষ্টি আকর্ষণ হয় তাঁর। বাদীর কাঠগড়ায় একটি সদ্য সাবালিকা মেয়ে। বয়স আঠার কিংবা উনিশ হবে। কোলে ছয় মাসের ফুটফুটে এক ছোট্ট শিশু কান্না করছে। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাইশ কিংবা তেইশ বছরের এক যুবক।
আদালত সূত্র থেকে জানা যায়, রাজশাহী মহানগরীর কাটাখালি থানার সমসাদিপুর গ্রামের শরিফুল ইসরামের ছেলে শিমুল পারভেজ এর সাথে একই গ্রামের স্বপন আলীর মেয়ে জান্নাত ফেরদৌস মিতুর ২০২১ সালের ২ এপ্রিল বিয়ে হয়। এর পরে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে আসামি বাদীনিকে তালাক দেন। ইতিমধ্যে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। জামিন শুনানিকালে বাদীনির চোখে পানি এবং আসামিকে মাথা নিচু করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বাদী ও আসামির পক্ষে-বিপক্ষে আইনজীবীদের বক্তব্য চলতে থাকলেও আদালতের দৃষ্টি ছিল অসহায় শিশুটির দিকে। শুনানীর এক পর্যায়ে বিচারক বলে উঠলেন শিশুটির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বাদী এবং আসামি এক হতে চায় কিনা?
ঠিক তখনই বাদীনি এবং আসামী পরস্পরের কিছু দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করেন আদালতের সামনে। আদালত মনোযোগ দিয়ে তাঁদের কথা শোনার পর বর্তমান সামাজের প্রেক্ষাপটে কিছু উপদেশমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। তারপর আদালতে বাদী বিবাদী উভয়েই যেন কিছুটা নমনীয় হয়ে যান। এক পর্যায়ে বাদী এবং আসামী উভয়ে আদালতের মধ্যস্থতায় নতুনভাবে সংসারে ফিরতে রাজি হন।
ঘড়িতে বেলা তখন দুপুর ১টা। রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ২ আদালতে তৈরি হয় এক উৎসবের আমেজ। একে একে আদালতের এজলাস কক্ষে হাজির হন মেয়ে পক্ষের অভিভাবক, ছেলে পক্ষের অভিভাবক, রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট পারভেজ তৌফিক জাহেদী, বাদী ও আসামী পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী, বিভিন্ন কোর্টের কর্মচারী ও বিচার প্রার্থীরা।
সর্বশেষ হাজির হন রাজশাহী মহানগর ৪ নং ওয়ার্ডের কাজী মো: জহিরুল ইসলাম। আদালতে কক্ষের ভিতরেই ১ লক্ষ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করে ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ছেলে এবং মেয়েকে বিয়ে পরানো হয়। বিয়ের পরেই আদালত অঙ্গনে শুরু হয় মিষ্টি বিতরণ। এ সময় উৎসুক জনতা বিবাহিত দম্পতিদের দেখতে আদালতে ভীড় করতে থাকেন। অনেকেই তাদের স্বাগতম জানান।
বিয়ে শেষে রাজশাহী মেট্রপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ২ আদালতের বিচারক মাসুদুজজামান (মির্জা মাসুদ) বাদীনি ও আসামিকে তার খাস কামরায় ডেকে নিয়ে সংসারের বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন এবং তাদের শিশুটিকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন বাদী পক্ষের আইনজীবী রেবেকা সুলতানা (সুমি), মোর্শেদা বানু হেনা, আসামী পক্ষের আইনজীবী মো: শহিদুল ইসলাম, রুবিনা খাতুন, বাদীর বাবা মো: স্বপন আলী, মা মিতা বেগম, আসামীর বাবা শরিফুল ইসলাম, মা শ্যামলি বেগমসহ আদালতের বেঞ্চসহকারী ও অন্যান্য কর্মচারীবৃন্দ।
এনিয়ে রাজশাহী আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, প্রতিটি সন্তানেরই স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। আদালতের মানবিকতায় আজ যে বিয়ে অনুষ্ঠিত হলো তা একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।