শাহানা হুদা
ভালোবাসার ও কাছের মানুষগুলো একসঙ্গে থেকে ছোট-বড় সুখ ও দুঃখ ভাগ করে নিতে পারাটা কি বেশি আনন্দের? নাকি একা একা আরাম-আয়েশে থেকে দিনযাপন করাটা বেশি সুখের? আমার বাবা বলতেন, তোমাদের ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব পাশে থেকে যদি শক্তি জোগায়, তাহলে সেখানেই তুমি সুখ খুঁজে পাবে। একা থাকার মধ্যে কোনো সুখ নেই। সবার সঙ্গে থাকলে কোনো কিছু না পাওয়ার দুঃখ সহজে স্পর্শ করতে পারে না। আর যখন অনুভব করতে পারবে যে তোমরা একা নও, তখন মানসিকভাবে শক্তি খুঁজে পাবে। সবাই সবার পাশে থাকলে মানুষ কখনো ভেঙে পড়ে না, নিঃসঙ্গ ও বিষণ্ন হয় না।
আমার বাবা মনোচিকিৎসক বা আচরণ বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। অথচ আজ থেকে ৫০ বছর আগে তিনি জীবনযাপনের সহজ ও সুখকর যে পথ আমাদের দেখিয়েছিলেন, এরই প্রকাশ দেখছি যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল ডা. ভিভেক মার্থির প্রতিবেদনে। তিনি বলেছেন, জনস্বাস্থ্যের পরবর্তী বড় সমস্যা হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। সামাজিক নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা দিনে ১৫টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি করে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। গবেষণা বলছে, নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৩০ শতাংশ বেশি। শুধু হৃদ্রোগ নয়, সামাজিকভাবে নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের স্মৃতিভ্রংশ, স্ট্রোক, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও অকালমৃত্যুর শিকার হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি।
চিকিৎসকেরা এখন দেখা সাক্ষাৎ করে পরিবার-পরিজন, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কম সময় কাটাতে বলছেন। পত্রিকায় পড়লাম, প্রখ্যাত সার্জন বিবেক মূর্তি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বহু মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভোগে। এই ভোগার অনুভূতিটা ক্ষুধা অথবা তৃষ্ণার মতো। তিনি বলেছেন, একাকিত্ব বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ‘ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়ার কোনো বিকল্প আসলে নেই। যোগাযোগের জন্য আমরা যত বেশি প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয়েছি, ব্যক্তি পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়া ততই হারিয়েছি।’
আধুনিক মানুষ এখন একা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ যখন ভালো থাকে, সুখে থাকে ও সুস্থ থাকে, তখন এই একা থাকাটা উপভোগ করে। কিন্তু হতাশা, বিষণ্নতা, ভয়, সন্দেহ, উদ্বেগ, জটিল কোনো সমস্যায় পড়লে অথবা মানসিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে বা শরীর খারাপ হলে মানুষ খুব নিঃসঙ্গ ও অসহায়বোধ করে। এই অসহায়ত্বের সময় হতাশা, ব্যর্থতা ও বিপর্যয় নেমে আসে মানুষের জীবনে। মানুষ তখন কাউকে পাশে চায়। সে হতে পারে তার পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী কিংবা স্বজন। যন্ত্র বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমাধান বয়ে আনে না। এখানে স্পর্শ বা মুখোমুখি সংলাপ দরকার হয়।
নিঃসঙ্গতা কিশোর-তরুণদের বেশি ভোগাচ্ছে। তারা অনেক বন্ধুর মধ্যে থাকলেও মূলত একাই থাকে। তারা আত্মীয়স্বজন ও পরিবারকে এড়িয়ে চলতে চায় এবং নির্ভর করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও যন্ত্রের ওপর। সে কারণে ডা. বিবেক মূর্তি পরামর্শ দিয়েছেন, কর্মস্থল, স্কুল, প্রযুক্তি কোম্পানি, সামাজিক সংগঠন, বাবা-মায়েরা যেন মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ানোয় ভূমিকা রাখেন।
এত দিন ধারণা করা হতো, একাকিত্বের কারণে মানুষ মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, একা থাকা ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে শারীরিক ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। প্রতিবেদনে জানানো হয়, একাকিত্বের কারণে অকালমৃত্যুর পরিমাণ বেড়েছে ২৬ শতাংশ। মানসিকভাবে শক্ত মানুষ সব বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আবার অনেকেই নিজের বিচ্ছিন্ন অবস্থাকে মেনে নিতে পারে না। এই একা হয়ে যাওয়া ব্যক্তির মধ্যে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। বয়স বাড়তে থাকলে এসবের সঙ্গে যুদ্ধ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে যেতে থাকে।
মানবসমাজের ইতিহাস সমাজবদ্ধ মানুষের কথা বলে। পরিবার ও সমাজ ছাড়া মানুষ বাঁচে না, বাঁচা কষ্টকর। বর্তমানের শহুরে নিরাপত্তা, সুবিধাদি, নানা প্রযুক্তিগত সুযোগ মানুষকে একা বাস করার কিছু সুযোগ হয়তো করে দিয়েছে, কিন্তু মানসিকভাবে মানুষ একা থাকা নিয়ে এখনো দুর্বল। এ কারণেই মানুষ নিজের দুঃসময়ে পরিবার, বন্ধু ও সন্তানের পাশে থাকতে চায়।
যদি বলি একাকিত্ব ও বন্ধুহীনতা থেকে সমাজে আত্মহত্যা বাড়ছে, সেটা খুব একটা ভুল বলা হবে না। অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদের হতাশা ও বিষণ্নতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হতাশা মানুষের সৃজনশীলতা, বোধ ও বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে দেয়। সব মানুষের ক্ষেত্রে চাপ গ্রহণ করার মানসিক ধরন ও শক্তি এক নয়। সবাই সব ধরনের আঘাত, প্রবঞ্চনা, লজ্জা, ব্যর্থতা, অশান্তি একভাবে মেনে নিতে পারেন না। মানসিকভাবে একা থাকার কারণে কারও সঙ্গে শেয়ার করারও সুযোগ পান না, তখন যেকোনো পথ খুঁজে নেন পালিয়ে বাঁচার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউরোসায়েন্টিস্ট ম্যাথিউ লিবারম্যান বলেন, ‘বেঁচে থাকতে সামাজিক যোগাযোগ প্রয়োজন এবং সেটা আমাদের দেহ জানে। তবে বিষয় হলো, একাকিত্বের মতো মানসিক আঘাত প্রমাণ করে যে সামাজিক যোগাযোগটা জরুরি।’ এখানে ‘একাকিত্বকে’ উনি ‘মানসিক আঘাত’ বলে মনে করছেন। তিনি বলেছেন, যেভাবে খিদে লাগলে পেট জানান দেয়, তেমনি কোনো কিছুর ঘাটতি হওয়ার সংকেত দেয় একাকিত্ব।
বিষণ্নতা, অর্থাৎ ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে যারা ভুগছে, তাদের বিষণ্নতা স্বাভাবিক মানুষের বিষণ্নতার মতো নয়। তাদের পুরো অস্তিত্ব গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। নিজের ওপর অনেক সময়ই আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। মানুষের পক্ষে ভালোবাসাহীন পরিবেশ বহন করা খুব কষ্টের। একাকিত্ব থেকে মুক্তির জন্যই পরিবারপ্রথার সৃষ্টি। আবার পরিবারকে যেন একা থাকতে না হয়, সে জন্য সমাজের সৃষ্টি। পরিবার ও সমাজের স্থান তাই ব্যক্তির ওপরে। আমরা অবশ্য ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার চাপে পড়ে তা ভুলে যাচ্ছি এবং স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি।
ব্রিগহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি ও নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ড. জুলিয়ান হল্ট-লান্সটেড গণমাধ্যমের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমাদের মস্তিষ্ক যোগাযোগের জন্য প্রস্তুত করা।’ দলের মধ্যে থেকে মানুষ কাজ করায় অভ্যস্ত। তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা যাদের বিশ্বাস করি, তাদের সান্নিধ্য আশা করি। তবে সেটা পাওয়া না গেল আমরা বিচ্ছিন্ন হই, আশপাশের মানুষদের আর বিশ্বাস করতে পারি না। অথবা সেই দল থেকে আমরা বের হয়ে যাই। এটা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য হুমকিস্বরূপ।’ একাকিত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব সবার ওপর সমানভাবে পড়ে না। যাদের ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যগত বা মানসিক সমস্যা রয়েছে বা আর্থিকভাবে দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি।
মানুষ কখনোই পুরোপুরি একা থাকে না। সবারই সামাজিক জীবন, মেলামেশা, বন্ধুত্ব, কাজের সম্পর্ক, প্রেম, পরিবার ইত্যাদি থাকে। তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন মানুষ কোনো কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে বা এমন সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, সে সম্পর্কে আবেগ বা ভালোবাসা থাকে না, শুধু স্বার্থ থাকে। স্বার্থের কারণে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেই সম্পর্ক নষ্ট হতে সময় লাগে না। আর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া মানে মানুষের নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া।
ইচ্ছা করেই হোক, যেকোনো কারণেই হোক, নিঃসঙ্গ থাকা সবার জন্যই ক্ষতিকর। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একা বোধ না করলেও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক সময় মানুষ এটা বুঝতে পারে না। তার খাওয়া, ঘুম, সেবা, আনন্দ ও দায়িত্ব পালনের বিষয়গুলো সব এলোমেলো হয়ে যেতে পারে, যা শরীরের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে।
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যই আমাদের পরিবার, বন্ধুত্ব, ভালোবাসার মতো পারস্পরিক সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে। পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে একজন অসহায় ও ভেঙে পড়া মানুষের। পরিবারের কোনো সদস্য বিপদে পড়লে যদি অন্য সদস্যরা তার পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে আমরা তাকে বিষণ্নতার মুখে ঠেলে দিচ্ছি।
শুধু কাজ বা সাফল্য যে মানুষকে একাকিত্ব কাটানোর, পরিপূর্ণভাবে সুখী করার ও বাঁচার রসদ দিতে পারে না, মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সে কথাই বলেছেন এভাবে, তরুণ বয়সে তিনি বুঝতে পারেননি যে কাজের বাইরেও একটা জীবন আছে। নিজের সম্পর্কগুলোকে যত্ন করার জন্য, সফলতা উদ্যাপনের জন্য এবং ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্যও সময় নিতে হবে, যখনই প্রয়োজন মনে হবে বিরতি নিতে হবে। সম্প্রতি নর্দার্ন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বলেছেন, তারুণ্য পেরিয়ে বার্ধক্যে পা রাখার আগপর্যন্ত তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি যে কাজের বাইরেও মানুষের আলাদা একটা জীবন রয়েছে। আর সেই জীবনই হলো সামাজিক জীবন।
যতই আমরা আধুনিক হই এবং যান্ত্রিক জগতে ব্যস্ত থাকি না কেন, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলোকে লালন করতে হবে, সবার পাশে থাকতে হবে, পছন্দসই মানুষের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে থাকার চেষ্টা করতে হবে। অন্যকে সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে অন্যরাও আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। মোটকথা, সুখ বা দুঃখ ভাগ করে নিতে হবে। মনীষীরা বলেন, ভাগ করে নিলে সুখ বাড়ে, আর দুঃখ কমে। আর দালাই লামা বলেছেন, সুখী থাকাই হচ্ছে ভালো স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
লিখেছেন: শাহানা হুদা, যোগাযোগকর্মী।