ইউরিক অ্যাসিড আমাদের সকলের শরীরেই তৈরি হয়। তবে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হলে দেখা দিতে পারে বড়সড় সমস্যা। সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে কিডনি অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড শরীর থেকে বের করে দেয়। আর বাকিদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড দেহ বের করে দিতে পারে না। তখন এই পদার্থটি শরীরে জমতে থাকে এবং ক্রিস্টাল আকারে বিভিন্ন জয়েন্টে জমে।
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি নিয়ে অনেকেই দুঃশ্চিন্তায় থাকি। ইউরিক অ্যাসিড কী, কেন বাড়ে, ভবিষ্যতে কী জটিলতা তৈরি করতে পারে কিংবা করণীয় কী, সেই সম্পর্কে জানা দরকার।
ইউরিক অ্যাসিড কী এবং কেন বাড়ে
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান বলেন, ইউরিক অ্যাসিড এক ধরনের নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্য পদার্থ। মানবদেহে বিপাক ক্রিয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয় এবং প্রস্রাবের সঙ্গে তা বের হয়ে যায়।
কোনো কারণে যদি কিডনির মাধ্যমে ইউরিক অ্যাসিড কম নিঃষ্কাশন হয় অথবা শরীরে কোনো কারণে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি বেড়ে যায়, তাহলে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে পারে।
ইউরিক অ্যাসিড কী কী কারণে বাড়তে পারে
ডা. আবেদ হোসেন বলেন, বেশ কিছু কারণে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে পারে। যেমন-
১. কিডনির সমস্যা থাকলে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে পারে।
২. অতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে।
৩. বিয়ার জাতীয় অ্যালকোহল পান করলে।
৪. সোরিয়াসিস জাতীয় চর্মরোগ।
৫. থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে।
৬. কিছু রক্তরোগ আছে যার কারণে ইউরিক অ্যাসিড বাড়তে পারে।
৭. ক্যান্সারের চিকিৎসা এবং কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে পারে।
৮. এ ছাড়া ইউরিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খেলেও এর মাত্রা বেড়ে যায়।
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে কী হয়
এ বিষয়ে ডা. আবেদ হোসেন বলেন, ইউরিক অ্যাসিড বেশি মানেই বড় রকমের শারীরিক সমস্যা আছে এমন নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই জিনগত কারণে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ইউরিক অ্যাসিড শরীরে কোনো সমস্যা তৈরি করে না।
তবে কিছু ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিড শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধিতে (হাড়ের জোড়া) ক্রিস্টাল হিসেবে জমা হয়ে প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এর ফলে অস্থিসন্ধি লাল হয়ে ফুলে যায় এবং প্রচণ্ড ব্যথার সৃষ্টি করে বলে জানান ডা. আবেদ হোসেন। এই অবস্থাকে গাউট বা গেঁটে বাত বলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গেঁটে বাতে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির গোঁড়ার অস্থিসন্ধি আক্রান্ত হয়। এ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড কিডনিতে পাথর বা অন্যান্য সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে জানান এই চিকিৎসক।
ইউরিক অ্যাসিডের লক্ষণ
জয়েন্টে ইউরিক অ্যাসিড জমা হলে জায়গাটা ফুলে যায়। প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এমনকি গরম ও লাল হয়ে যায়। এখন আপনার শরীরেও যদি এই লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তার কথামতো টেস্ট করান। তবেই ভালো থাকতে পারবেন।
শরীরে পিউরিন নামক একটি যৌগের পরিমাণ বাড়লে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে। এবার এই পিউরিন পাওয়া যায় বিভিন্ন কোষকলায়। শরীরে পিউরিন বাড়তে শুরু করলে তখন কিডনি আর এই যৌগটিকে বের করে দিতে পারে না। তখনই এই ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টাল হিসেবে জমতে থাকে।
ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকা হলো একটি বিপাকীয় সমস্যা। এক্ষেত্রে শরীরের বিপাক ক্রিয়া ঠিকমতো না হলে এই জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন।
যেসব খাবার শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ায়
ডা. আবেদ হোসেন বলেন, সুস্থ থাকতে শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ায় যেসব খাবার সেগুলো পরিহার করা উচিত। যেমন-
লাল মাংস, যেমন- গরু, খাসি, ভেড়া বা হাঁসের মাংস, মগজ, কলিজা, গুর্দা (কিডনি), ফুসফুস, মুরগির চামড়া, চিংড়ি, কাঁকড়া, শুঁটকি ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার, কোমল পানীয়, বিয়ার জাতীয় অ্যালকোহল, অতিরিক্ত লবণ।
কী খেতে পারবেন
শাকসবজি, ডাল, ডিম, দুধ এগুলো খেতে কোনো বাধা নেই বলে জানান ডা. আবেদ হোসেন। তিনি বলেন, ডাল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, বীজ এবং অন্যান্য কিছু সবজি আগে ইউরিক অ্যাসিড বেশি থাকলে খেতে নিষেধ করা হতো। কিন্তু এখন দেখা গেছে, এই সবজিগুলো ইউরিক অ্যাসিড বাড়ানোতে বা রোগ সৃষ্টিতে কোনো ভূমিকা রাখে না। এজন্য এখন সবজি খেতে নিষেধ করা হয় না।
এ ছাড়া অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ওষুধ পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে, যদি রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়ে যায়।
ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে কী করবেন
অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, কিডনির সমস্যা বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানান ডা. আবেদ হোসেন।
সব ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজ থেকে কোনো ওষুধ সেবন না করা এবং বন্ধ না করার পরামর্শ দেন তিনি। নিজ থেকে কোন পরীক্ষা করা বা কোনো ওষুধ সেবন করার প্রয়োজন নেই।
ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দেন ডা. আবেদ হোসেন।
এইচএ