এইমাত্র
  • জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারের শোক প্রকাশ, দ্রুত বিচার আহ্বান
  • লোহাগড়ায় অবৈধ ৩৭ টি ইটভাটায় পরিবেশের বিপর্যয়
  • ৩ দলের সমন্বয়ে নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ
  • ঝিনাইদহে ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুন
  • কিশোরগঞ্জে শিশু হত্যা মামলা তুলে নিতে স্বামীর নির্যাতনের অভিযোগ
  • ব্রিসবেনেও ইংলিশদের ভরাডুবি
  • নিজ গ্রামে জনতার রোষানলে ব্যারিস্টার ফুয়াদ
  • বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ
  • সাংবাদিক শওকত মাহমুদ গ্রেপ্তার
  • যশোরে স্বর্ণসহ পাচারকারী আটক
  • আজ রবিবার, ২৩ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
    মুক্তমত

    বিশ্বজুড়ে ‘ডানপন্থীদের’ উত্থান, বাংলাদেশে?

    রবিন দাস প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম
    রবিন দাস প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম

    বিশ্বজুড়ে ‘ডানপন্থীদের’ উত্থান, বাংলাদেশে?

    রবিন দাস প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫৩ পিএম

    সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত বিষয়বস্তু ‘ডানপন্থীদের’ উত্থান। ইউরোপ থেকে দক্ষিণ এশিয়া কিংবা লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য সর্বত্রই এক নতুন রূপে ফিরে আসছে রাজনীতিরি এই ধারা। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির আলোচিত মুখ ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও প্রথাগতভাবে ডানপন্থী বলা যায়। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে এক ধরনের ‘রাইট টার্ন’ দেখা যাচ্ছে। যার প্রভাব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গণতান্ত্রিক কাঠামো, সামাজিক সহাবস্থান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রতিটি স্তরে।

    ডানপন্থী রাজনীতি হলো এমন এক ধারা, যেখানে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয় ঐতিহ্য, ধর্ম, জাতীয় পরিচয় ও জাতীয়তাকে। এটি প্রায়শই মুক্ত বাজার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে সমর্থন করে, এবং সামাজিকভাবে প্রথাগত মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান নেয়।

    এই ডানপন্থার আবার বেশ কয়েকটি প্রকার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রতিক্রিয়াশীল ডান, মধ্যপন্থী ডান, উগ্র ডানপন্থী, চরম ডানপন্থী। ১৯৮০’র দশকে সমাজতন্ত্রকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং মধ্যপন্থী ডানদের উদ্ভব হলেও বর্তমানে আবারও উগ্র এবং চরম ডানপন্থা বিশ্বজুড়ে জেকে বসেছে।

    ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোয়ান, সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী গির্ট উইলডার্স ইউরোপের ডানপন্থার নতুন উত্থানের প্রতীক। অস্ট্রিয়ার পিপলস পার্টি ২০০০ সালে ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে প্রথম জোট গঠন করে। ২০২৪ সালে দেশটির নির্বাচনে আরও চরমপন্থী হওয়া এই দলটিই নির্বাচনে প্রথম স্থান অর্জন করে।

    সবশেষ আর্জেন্টিনার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ৪১ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন চরম ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত হাভিয়ের মিলেই। তার এই বিজয় বৈশ্বিক রাজনীতিতে উদীয়মান ডানপন্থী ও জনতুষ্টিবাদী প্রবণতারই প্রতিফলন।

    জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অলিভিয়ার দে শুটারের মতে, দশকের পর দশক ধরে কল্যাণরাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা কমানো বা ‘অস্টারিটি’ নীতিই ডানপন্থী উত্থানের মূল কারণ।

    তবে বিশ্বজুড়ে এই ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের পেছনে আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ আছে। এগুলো হলো-

    ১) অভিবাসন: বিশ্বজুড়ে এখন এক বড় সমস্যা অভিবাসন। উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপ ও আমেরিকায় অভিবাসীদের ঢল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ও চাকরির নিরাপত্তা ভয় সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা বিশ্বে এর বিরুদ্ধে অবস্থান করে ডানপন্থীরা বলছে, ‘বিদেশিরা আমাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতি দখল করছে।’ সবশেষ মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিবাসন নীতিকে ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর অভিবাসনের জন্য আইনও করেছেন।

    ২) অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া: বিশ্বায়নের প্রভাবে যেমন নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে তেমনি আবার আয়ের বৈষম্যও তৈরি করেছে। এর কারণে বড় শহর ও কর্পোরেট শ্রেণী লাভবান হলেও গ্রামীণ ও নিম্ন-ব্ত্তি জনগোষ্ঠী পিছিয়ে পড়ছে। মার্কিন নির্বাচনের সময় ডোনাল্ট ট্রাম্পের শিবিরি প্রচার করেছিল, ‘চীনে শিল্প চলে গেছে, মেক্সিকানরা চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, আর ওয়াশিংটনের এলিটরা শুধু বড় করপোরেটের স্বার্থ রক্ষা করছে।’ তাদের এমন প্রচারণা ভোটার আকর্ষণ করতে সমর্থন হয়।

    ৩) গণতন্ত্রে হতাশা ও নেতৃত্বে আস্থাহীনতা: গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধীর সিদ্ধান্ত ও দুর্নীতির অভিযোগ অনেক নাগরিককে হতাশ করে তোলে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ডানপন্থী নেতা ও দলগুলো নিজেদের ‘বিকল্প’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে ইতালি হতে পারে সবচেয়ে বড় উদহারণ। দেশটিতে ২০১৩ সালের পরে কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণকালীন মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পর্যায়ক্রমে দেশের প্রায় সব প্রধান রাজনৈতিক দলই জনমতের আস্থা হারিয়েছে। আর এখানেই উত্থান ঘটে জর্জিয়া মেলোনির আর তার “Brothers of Italy” দলের। যার ফল ২০২২ সালের নির্বাচনে পুরো বিশ্ব দেখেছে। একই কারণে ব্রাজিলে জইর বলসোনারো এবং এল সালভাদোরে নায়িব বুকেলের মতো ডানপন্থীদের উত্থান ঘটে।

    ইকুইটেবল গ্রোথের ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ‘জনতুষ্টিবাদী ভোটাররা এক ধরনের বঞ্চনা বোধে ভুগছে, যা বিশ্বের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করছে। শিল্পখাতের অবক্ষয় ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন তাদের ঐতিহ্যবোধ ও পরিচয়ের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।’

    এদিকে বাংলাদেশেও বর্তমানে ডানপন্থী রাজনীতির এক উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই প্রবণতা দেখা গেছে। যদিও বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতে ডানপন্থী রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

    পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ডানপন্থী রাজনীতি বলতে বিশ্বাস করে, সামাজিক শৃঙ্খলা, শ্রেণিবিন্যাস এবং ঐতিহ্যকে সমর্থন। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ায় “ডানপন্থী রাজনীতি” বলতে বোঝানো হয় ধর্ম, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক রক্ষণশীলতাকে। আর বাংলাদেশে ‘ডানপন্থী রাজনীতি’ বলতে অনেকেই কেবল ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই ইঙ্গিত করে থাকনে। পার্শবর্তী দেশ ভারতেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভারতে প্রায় ১১ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, ধর্মীয় আবেগ এবং কট্টর জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তারা ভোটার আকর্ষণ করছে।

    বাংলাদেশে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো ছিল কোণঠাসা। সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা মিডিয়া কাভারেজ কোনোক্ষেত্রেই তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল না। তবে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে একধরনের শূণ্যতা তৈরি হলে এই দলগুলো মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

    গত জুলাই মাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সমাবেশের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি জানান দেয় জামায়েত ইসলামী। সেই সমাবেশে দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আগামী দিনে সংসদে কেবল ইসলাম থাকবে। কোরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য কোনো মতবাদ চলবে না।

    তাছাড় গত এক বছরের বেশি সময়ে দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা ছাড়াও বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনায় ‘ডানপন্থী’ দলগুলো নিজেদের জড়িয়েছে। বিশেষ করে মাজার ভাঙা, থিয়েটার বন্ধ, বাউলদের বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর কিংবা নারীদের ফুটবল ম্যাচ বাতিল সহ পোশাক নিয়ে নারীদের হেনস্তার মতো অভিযোগ আছে দলগুলোর বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ‘ডানপন্থী’ রাজনীতির চর্চা এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

    বাংলাদেশে ‘ডানপন্থী রাজনীতি নতুন নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কিছুটা ‘দেয়ালে পিঠ ঠেকা’ অবস্থায় ছিল ‘ডানপন্থী’ দলগুলো। এরপর ৮০’র দশকে আবারও উত্থান ঘটে এই দলগুলোর। মাঝের সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকলেও বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে বড় ‘কি ফেক্টর’ হয়ে উঠেছে দলগুলো।

    এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা দেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের অনুপস্থিতি এবং সেক্যুলার দলগুলোর দুর্বলতাকে দায়ী করছেন। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বরং এটিকে রাজনৈতিক ভারসাম্যের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই দেখছেন অনেকে।

    তবে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে ‘ডানপন্থীদের’ এমন দাপট স্থায়ী হবে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। অনেকের মতে, এটি নির্ভর করে আগামী নির্বাচনের ফল এবং নতুন সরকারের ওপর।

    বিশ্বজুড়ে ডানপন্থীদের এমন উত্থানের পর ইকুইটেবল গ্রোথ এক পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে চরম ডানপন্থা ও জনতুষ্টিবাদীদের সমর্থন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। তবে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এই প্রবণতা উল্টে দেওয়া সম্ভব।

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    চলতি সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

    Loading…