চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীর খানখানাবাদ পরিণত হয়েছে অপরাধের অভয়ারণ্যে। খানখানাবাদ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রেমাশিয়া গ্রাম; যে গ্রাম একসময় ছিল উপকূলের প্রাণচঞ্চল ও শান্তিপূর্ণ এলাকা, এখন পরিচিত ভয়, আতঙ্ক ও নৈরাজ্যের ঠিকানা হিসেবে। স্থানীয়দের মতে, 'এখন প্রেমাশিয়া মানেই ওয়াজেদের রাজত্ব।'
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই জনপদের নিয়ন্ত্রণ এখন এক ব্যক্তির হাতে–ওয়াজেদ মোহাম্মদ (৪০)। স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ‘ডাকাত আবুর ছেলে’ নামে। কারণ, তার পিতা মৃত আবু ছিদ্দিক ওরফে ‘ডাকাত আবু’ ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকূলজুড়ে কুখ্যাত এক জলদস্যু ও ডাকাত দলের নেতা।
ডাকাত আবুর মৃত্যুর পর, তার ছেলে ওয়াজেদ বাবার রেখে যাওয়া নৌসংযোগ, অস্ত্রভাণ্ডার ও ভয়ভীতি নির্ভর প্রভাব ব্যবহার করে গড়ে তোলেন এক ভয়াবহ অপরাধ সাম্রাজ্য। গত এক দশকের সেই সাম্রাজ্য এখন মাদক, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও কিশোর অপরাধের এক বিপজ্জনক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
ওয়াজেদ মাহমুদের উত্থান হয় আওয়ামী লীগ সরকারের সময়। তিনি বাঁশখালীর সাবেক সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিআইপি মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাছাড়া খানখানাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি হিসেবে দলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপে তিনি গড়ে তোলেন প্রভাব ও ক্ষমতার বলয়।
রাজনীতির ছায়া ব্যবহার করে ওয়াজেদ তার এলাকায় ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করেন মাদক কারবার, চাঁদাবাজি, ভূমিদখল ও অস্ত্রবাজীর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, 'প্রেমাশিয়া এখন তার রাজত্ব। থানার কেউ সেখানে তার অনুমতি ছাড়া ঢোকার সাহস করে না।'
একজন স্থানীয় দোকানদার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'বাংলা মদ, গাঁজা, ইয়াবা–সব কিছু বিক্রি হয় তার অনুমতিতে। যারা বাধা দেয়, তাদের বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হয়রানি করা হয়।'
ওয়াজেদ মাহমুদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতা প্রশ্ন তুলেছে। অভিযোগ রয়েছে, ওয়াজেদ নিয়মিত পুলিশ ও রাজনৈতিক মহলে অর্থ ও সুবিধা দিয়ে নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করে রেখেছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বাঁশখালী থানার বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজনু মিয়া এবং বিএনপি-জামায়াতের একাধিক প্রভাবশালী নেতার সহযোগিতায় এলাকাজুড়ে তার দাপট অব্যাহত রয়েছে। এমনকি, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পরও তিনি সফলভাবে রঙ বদলে ফেলেছেন! এক সময় আওয়ামী ঘনিষ্ঠ এই ওয়াজেদ এখন বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নেতাদের ছত্রছায়ায় আত্মরক্ষা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাঁশখালী থানার সাবেক এক পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, 'ওয়াজেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক যোগাযোগের কারণে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারে না।'
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, প্রেমাশিয়া এলাকায় বর্তমানে চারটি সক্রিয় কিশোর গ্যাং কাজ করছে, যাদের নেতৃত্বে রয়েছেন- ওয়াজেদ মোহাম্মদ। এই গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করে এলাকায় ভয় ও আধিপত্য বজায় রাখেন তিনি। গ্রামের ভেতরে নির্জন একটি ঘরে বাংলা মদ, গাঁজা, ইয়াবা পাইকারী ও খুচরা বিক্রির কারখানা চালায় তার সহযোগীরা।
স্থানীয় এক জেলে বলেন, 'রাতে ট্রলার নিয়ে সাগরে যায় তার লোকেরা। ভোরে ফিরে আসে ইয়াবা আর গাঁজার বোঝা নিয়ে। পুলিশ সব জানে, কিন্তু কেউ মুখ খোলে না।'
অভিযোগ রয়েছে, ওয়াজেদ তার গ্যাংয়ের মাধ্যমে স্থানীয় জেলেদের ওপর ভয়ভীতি দেখিয়ে মাদক পরিবহনে বাধ্য করেন। যারা অস্বীকৃতি জানান, তাদেরকে মামলা-হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেওয়া হয়।
ওয়াজেদ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে শুধু মাদক ব্যবসা নয়, রাজনৈতিক হামলারও অভিযোগ রয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে বাঁশখালী উপজেলার চাম্বল ইউনিয়নে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের ওপর হামলায় ওয়াজেদপন্থী কিশোর গ্যাংয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
তার টাকার প্রভাবের কারণে তখনকার ওসি তোফায়েল আহমেদ কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভ্যুত্থানের পর বর্তমান ওসি সাইফুল ইসলামও নীরব ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
একজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'ওয়াজেদ এখন প্রেমাশিয়ার রাষ্ট্রপতি। পুলিশও তার সামনে মাথা নোয়ায়। তার নির্দেশেই সমস্ত অপরাধ সংগঠিত হয়।'
ওয়াজেদের পিতা ‘ডাকাত আবু’ ছিলেন একসময় দক্ষিণ উপকূলজুড়ে আতঙ্কের নাম। তার বিরুদ্ধে শতাধিক ডাকাতি, অপহরণ ও হত্যার মামলা ছিল।
পুরনো পুলিশ রেকর্ড বলছে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ‘আবু ডাকাত’ উপকূলীয় জলদস্যু চক্রের প্রধান ছিলেন।
বাবার মৃত্যুর পর, পুত্র ওয়াজেদ তার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অস্ত্রভাণ্ডার ও সমুদ্রপথের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে স্থলভাগে অপরাধ বিস্তার শুরু করেন। এখন সেই প্রভাব বিস্তৃত পুরো খানখানাবাদ ইউনিয়নজুড়ে। ওয়াজেদ গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পান স্থানীয়রা।
অভিযোগ তোলার পর উল্টো হয়রানির শিকার হন কেউ কেউ। একজন স্কুল শিক্ষকও নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বলেন, 'পুলিশের কাছে গেলে উল্টো বিপদ হয়। অতীতে ও বর্তমানে আমাদের অভিযোগ শুনতে চায় না তারা। প্রেমাশিয়ায় এখন ওয়াজেদের কথাই শেষ কথা।'
এ সব ব্যাপারে সময়ের কন্ঠস্বর-কে মুঠোফোনে ওয়াজেদ মাহমুদ বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রনোদিত। আমার কোন রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কারও সঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আমার কোন শত্রু নেই। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী ভাল বলতে পারবে।’
‘আবু ডাকাত’ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওয়াজেদ বলেন, ‘আমার বাবা এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি একসময় জলদস্যুদের ধরিয়ে দিতে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। এ জন্য তাকে পুলিশ ও নৌ বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে সনদপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, আমার বাবা ডাকাত ধরিয়ে দেওয়ার কারণে তার প্রাণনাশেরও আশঙ্কা ছিল। তাই তার সুরক্ষায় পুলিশি প্রটোকলও তাকে দেওয়া হয়।’
বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজনু মিয়ার সঙ্গে ‘সু-সম্পর্ক’ থাকার বিষয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘মজনু মিয়াকে ৪/৫ বছর ধরে চিনি। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় এক বৈঠকে। এক দুর্ঘটনায় এলাকার একজন লোক মারা যায়। সে ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয়দের এক বৈঠক হয়। সে সময় থেকে চিনি ‘
ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ থাকার বিষয়ে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজনু মিয়া সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি ২ বছর হলো। ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে এরকম কোন সম্পর্ক আমার নেই।’
তবে, দুজনের কথায় পরিচয়ের ব্যাপারে অমিল থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৪/৫ বছর কী-ভাবে হয়? আমি এখানে এসেছি ২ বছর হলো। প্রায় ২ বছর আগে ওয়াজেদ মিয়ার বোন অপহরণের শিকার হন। সে ব্যাপারে ওয়াজেদ মিয়ার পরিবার থানায় সাধারণ ডায়রি করেন। তখন থেকে চিনি।’
তিনি বলেন, ‘ওয়াজেদ মিয়া আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ জন্য হয়তো তার পেছনে লোক লাগতে পারে। তবে, আমার সঙ্গে তার এমন কোন সম্পর্ক নেই।’ তিনিও তার বক্তব্যে ওয়াজেদ মিয়াকে নির্দেোষ দাবি করেন।
বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলাম সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘ওয়াজেদ মিয়ার নামে কোন অভিযোগ পাইনি। এ প্রথম আপনার থেকে শুনলাম। তবে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো বিষয়টি।’
বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজনু মিয়ার সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়ার ‘সু-সম্পর্ক’র বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। আমার জানা মতে মজনু মিয়া কোন অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।’
এসকে/আরআই