গ্রামীণ মেঠোপথ পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে (BGSU) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সন্তান ড. ইমরান হাসান তুষার। শিক্ষা, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের অনন্য সমন্বয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রত্যন্ত গ্রামের একজন তরুণও ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে পারে।
শাহজাদপুর উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া তুষার দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে বড়। তাঁর বাবা বকুল হোসেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এবং মা গৃহিণী। তুষার মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন শাহজাদপুর পাইলট হাই স্কুল থেকে।
অল্প বয়স থেকেই পড়াশোনায় অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন তিনি। ২০০৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক ট্যালেন্টপুল বৃত্তি অর্জন করেন এবং ২০০৭ সালে গণিত অলিম্পিয়াডে শাহজাদপুর উপজেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন। এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ অর্জনের মাধ্যমে তাঁর একাডেমিক উৎকর্ষ আরও স্পষ্ট হয়।
পরবর্তীতে ভর্তি হন ঢাকার নটর ডেম কলেজে, সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে স্থান পান দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ। বুয়েট থেকে তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
পরে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তুষার পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং ভর্তি হন লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি (LSU)-এর পিএইচডি প্রোগ্রামে। সেখানে তিনি অর্জন করেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত Economic Development Assistantship (EDA) ফেলোশিপ—যা কেবলমাত্র বিশ্বের সেরা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রদান করা হয়। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বিশেষ করে অফশোর উইন্ড ফার্মের লজিস্টিক্স ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার খরচ কমানোর উপায় উদ্ভাবন।
পিএইচডি চলাকালে তিনি সুপারভাইজারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে পাঁচটি বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গবেষণা উপস্থাপন করেন।
বর্তমানে ড. তুষার যুক্তরাষ্ট্রের বোলিং গ্রিন স্টেট ইউনিভার্সিটি (BGSU)-এর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। সেখানে তিনি গবেষণা পরিচালনা করছেন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, অপ্টিমাইজেশন, আধুনিক ম্যানুফ্যাকচারিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নিয়ে। গবেষণা ও শিক্ষাদানে AI প্রয়োগের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অর্জন করেছেন AI Champion Award 2025, যা তাঁকে প্রদান করেছে BGSU কর্তৃপক্ষ।
BGSU-তে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন Advanced Industrial and Manufacturing Systems (AIMS) Lab, যেখানে আমেরিকান ও অন্যান্য দেশের গবেষকদের পাশাপাশি ছয়জন বাংলাদেশি স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীও কাজ করছেন। তাঁরা একসঙ্গে ম্যানুফ্যাকচারিং ও সাপ্লাই চেইন সিস্টেমের জটিল সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের তরুণ গবেষকদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
এছাড়া ড. তুষার বিশ্বের শীর্ষ গবেষণা সংস্থাগুলোর কাছে একাধিক বৃহৎ গবেষণা প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন (NSF), অ্যামাজন রিসার্চ অ্যাওয়ার্ডস এবং ওহাইও ডিপার্টমেন্ট অব হায়ার এডুকেশন (ODHE)। এসব প্রস্তাবনার আর্থিক মূল্য ৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা তাঁর গবেষণার পরিধি ও উচ্চাভিলাষের প্রতিফলন।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা অনুদান প্রস্তাব মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করছেন এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালের রিভিউয়ার হিসেবেও কাজ করছেন, যা বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সমাজে তাঁর দক্ষতা ও বিচারের প্রতি আস্থার প্রকাশ।
নিজের সাফল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. তুষার বলেন, 'আমি আমার শিকড়কে কখনো ভুলিনি। ছোটবেলা থেকেই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখতাম, একদিন বিশ্বমঞ্চে পরিচিতি পাবো। শাহজাদপুর পাইলট হাই স্কুল থেকে নটর ডেম কলেজ, বুয়েট, LSU আর এখন BGSU-এই দীর্ঘ যাত্রা আমাদের দেশের তরুণদের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প। আমি চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষার্থী বিশ্বাস করুক, অধ্যবসায়ই সাফল্যের একমাত্র চাবিকাঠি।'
এসকে/আরআই