গ্রাম-বাংলার অতি পরিচিত একটি গুল্ম হল ফুরফুরি গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Scoparia dulcis। ক্ষেতের আইল বা পরিত্যাক্ত জায়গায় গাছটি প্রায়শই চোখে পড়ে। এর হালকা মিষ্টি স্বাদ এবং পাতা ঘষলে এক প্রকার সুগন্ধ বের হওয়ার কারণে এটি অনেকের কাছেই পরিচিত। এই সাদামাটা গাছটি আদতে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসায় এক অমূল্য রত্ন।
প্রচলিত নাম ও পরিচিতি: ফুরফুরি গাছকে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। যেমন, মিষ্টি ঝাড়ু (Sweet Broomweed), চিনি গাছ (চিনির মতো মিষ্টি স্বাদের জন্য), বন মরিচ,বন তুলসি। এই গাছটি বহুবর্ষজীবী এবং প্রায় এক ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এর পাতাগুলো ছোট, ডিম্বাকার এবং ফুলগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির, সাধারণত সাদা রঙের।
ফুরফুরি গাছের বৈজ্ঞানিক ভেষজ গুণাগুণ: আধুনিক গবেষণা এবং লোক-চিকিৎসা উভয়ই ফুরফুরি গাছের অসাধারণ ভেষজ গুরুত্ব তুলে ধরেছে। এর মূল, কাণ্ড, পাতা সবকিছুই ঔষধি গুণে ভরপুর।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে: ফুরফুরি গাছের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা ফ্লাভোনয়েডস (Flavonoids) এবং ট্রাইটারপেনয়েডস (Triterpenoids) নামক যৌগগুলি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং গ্লুকোজের শোষণ কমাতে সহায়ক হতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে, ডায়াবেটিস রোগীরা এর পাতার রস বা ক্বাথ সেবন করে থাকেন।
উচ্চ রক্তচাপ কমাতে: এই ভেষজটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ফুরফুরি গাছের নির্যাস রক্তনালীকে শিথিল করে এবং মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে, যা উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কমাতে সহায়তা করে।
জ্বর ও প্রদাহ উপশমে: ফুরফুরি গাছের ক্বাথ বা পাতার রস জ্বর কমাতে বা জ্বরনাশক (Antipyretic) হিসেবে খুবই উপকারী। একইসঙ্গে, এতে থাকা যৌগসমূহ শরীরের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক প্রদাহ (Inflammation) কমাতে সাহায্য করে। এটি বাতের ব্যথা বা ফোলা কমাতে লোক-চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শক্তি: ফুরফুরি গাছ হলো প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট-এর ভান্ডার। এই অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলি শরীরের ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিকেলস (Free Radicals) এর বিরুদ্ধে লড়াই করে, যা কোষের ক্ষয় রোধ করে এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে।
যকৃতের সুরক্ষায়: ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায়, এই গাছটিকে যকৃত (Liver)-এর সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ফুরফুরি গাছের নির্যাস যকৃতের কোষকে টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।
ব্যবহারের প্রথাগত পদ্ধতি। ফুরফুরি গাছ সাধারণত নিম্নলিখিত উপায়ে ব্যবহার করা হয়।
ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রস্তুত প্রণালী ও উপকারিতা
** ডায়াবেটিস পাতার টাটকা রস বা শুকনো পাতার ক্বাথ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
** জ্বর/সর্দি-কাশিতে এই গাছের পাতা ও কাণ্ডের সাথে আদা মিশিয়ে ক্বাথ তৈরি করে নিতে হবে। ফলে জ্বর কমায়, শ্বাসযন্ত্রের আরাম দেয়।
** পেটের সমস্যা মূল ও পাতার পেস্ট অল্প পরিমাণে সেবন করতে হবে। হজম উন্নত করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
** পাতার পেস্ট বা রস ত্বকের ক্ষতস্থানে সরাসরি প্রয়োগ করতে হবে।ফলে দ্রুত আরোগ্য এবং সংক্রমণ রোধ হবে।
সতর্কতা: ফুরফুরি গাছ একটি প্রাকৃতিক ভেষজ হলেও, এর ব্যবহারে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যেকোনো ভেষজ চিকিৎসার ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থায় বা গুরুতর অসুস্থতায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যিক। ডায়াবেটিসের ওষুধ গ্রহণকারী ব্যক্তিরা এই গাছ সেবন করলে রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, ফুরফুরি গাছ কেবল একটি আগাছা নয়, এটি আমাদের প্রকৃতির এক নীরব চিকিৎসক। এর বহুমুখী ভেষজ গুণাগুণ এটিকে আধুনিক ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্থান দিয়েছে। প্রয়োজন শুধু এই অমূল্য সম্পদকে সংরক্ষণ করা এবং সঠিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর গুণাগুণকে কাজে লাগানো।
এইচএ