'সব সখিরে পার করিতে নিব আনা আনা,
তোমার বেলায় নিব সখি তোমার কানের সোনা,
সখি গো… আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি,
তোমার কাছে পয়সা নিব না'।
সিনেমা প্রেমী দর্শকদের হৃদয়ে আজও গেথে আজে সেই খেয়া ঘাটের মাঝির গান। সেই খেয়া ঘাটের মাঝি সবার প্রিয় মিয়া ভাই বা আকবর হোসেন পাঠান আজ সোমবার (১৫ মে) সকাল ৮ টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে বড় পর্দা মাতিয়েছেন ফারুক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকা-১৭ আসনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
২০২১ সালের ৪ মার্চ সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। চেকআপের পর তখন তার ইনফেকশন ধরা পড়লে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন এই অভিনেতা। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ফারুক।
১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চিত্রনায়ক ফারুক। দেশের মানুষ তাকে চিত্রনায়ক ফারুক নামেই চিনে। যিনি তার জীবন বাজী রেখে স্বাধীন এই দেশের জন্য ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে।
পুরান ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা ফারুকের শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে সেখানেই। ফারুক স্কুল জীবন থেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন এবং সেসময়ে তার নামে প্রায় ৩৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।
কর্মজীবনে এই চিত্রনায়ক ১৯৭১ সালে এইচ আকবর পরিচালিত 'জলছবি' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে পা রাখেন। এতে বিপরীতে নায়িকা হিসেবে দেখা যায় প্রয়াত অভিনেত্রী কবরীকে। এর পরে তিনি ১৯৭৩ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত 'আবার তোরা মানুষ হ', ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত 'আলোর মিছিল' দুটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৭৫ সালে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত 'সুজন সখী' ও 'লাঠিয়াল' দুটি ব্যবসাসফল ও আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর 'লাঠিয়াল' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৬ সালে ফারুক অভিনীত তিনটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। এগুলো হল সূর্যগ্রহণ, মাটির মায়া ও নয়নমনি। চলচ্চিত্র তিনটির জন্য বিভিন্ন বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। পরের বছর ১৯৭৭ সালে শহীদুল্লাহ কায়সার রচিত কালজয়ী উপন্যাস সারেং বউ অবলম্বনে নির্মিত 'সারেং বৌ' ও আমজাদ হোসেন পরিচালিত গোলাপী এখন ট্রেনে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্র দুটি নারীকেন্দ্রিক হলেও তার অভিনয় সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে।
১৯৭৯ সালে তার অভিনীত নাগরদোলা, দিন যায় কথা থাকে, কথা দিলাম, মাটির পুতুল, সাহেব, ছোট মা, এতিম, ঘরজামাই চলচ্চিত্রগুলো ব্যবসাসফল হয়। ১৯৮০ সালে সখী তুমি কার ছায়াছবিতে শাবানার বিপরীতে শহুরে ধনী যুবকের চরিত্রে অভিনয় করে সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে 'মিয়া ভাই' চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে মিয়া ভাই হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
ব্যক্তিগত জীবনে রূপালী পর্দার সদ্য প্রয়াত এই গুনী নায়ক ফারজানা পাঠানকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে। কন্যা ফারিহা তাবাসসুম পাঠান ও পুত্র রওশন হোসেন।
সদ্য প্রয়াত এই কিংবদন্তি নায়ক অভিনীত প্রায় নব্বই ভাগ চলচ্চিত্র ব্যবসা সফল হয়েছে। যার স্বীকৃতি স্বরূপ সম্প্রতি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬-এর পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা নায়ক ফারুক ও নায়িকা ববিতার নাম ঘোষনা করা হয় (যৌথ ভাবে)। যদিও বিষয়টি নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি।
মিয়াভাই খ্যাত এই নায়ক প্রয়ানের আগে আলাপকালে দাবি করেন, দীর্ঘ চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারে তাকে ১৯ বার সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দিতে গিয়েও বাদ দেয়া হয়েছে । তার অপরাধ তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করে। তাই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে তার আর কোনো আগ্রহ নেই। আজীবন সম্মাননা পুরস্কার মানুষের জীবনে একবার আসে। এটা বার বার প্রদান করা হয় না। সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি এর মাধ্যমে প্রদান করা হয়। পৃথিবীর সবদেশের নিয়ম হলো এই স্বীকৃতি দেয়া হয় একজনকে। একসঙ্গে দুজনকে দিলে প্রাপ্তির আনন্দটা ফিকে হয়ে যায়। তাই এটি সম্মানের নামে অসম্মান করারই নামান্তর ও দুঃখজনক বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, চিত্রনায়ক ফারুক সবশেষ ২০০৮ সালে আজাদী হাসানাত ফিরোজ পরিচালিত 'ঘরের লক্ষ্মী' সিনেমায় অভিনয় করেন।
আরআইআর