বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকের কল্যাণে নানান ঘটনার সাক্ষী হন মানুষ। ভালো, খারাপ অনেক কিছু ভাইরাল হয় ফেসবুকে। সেগুলোতে কেউ পান বাহবা, কেউ পান ধিক্কার। মা দিবসে মাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অনেকেই অনেক কিছু করেছেন। সেগুলো নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলেও শেয়ার করেছেন।
তবে কামরুন নাহার ও এন এম শরীয়ত উল্লাহ দম্পতির জন্য এবারের মা দিবস ছিল একেবারেই অন্যরকম। বিশেষ এক কাজের জন্য তাদের বাহবা দিচ্ছেন পুরো দেশের মানুষ। ফেসবুকে নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে এক পরিবার তাদের দীর্ঘদিনের গৃহসঙ্গী (যাকে আমরা সাধারণ বুয়া বলে থাকি) তার বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছেন।
শনিবার ৮ মে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব তাহসিনা আফরিনের ফেসবুক পোস্টে দেখা যায় এই অসাধারণ মুহূর্ত। তাহসিনা আফরিনের মা সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যাপক কামরুন নাহার ও বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা এন এম শরীয়ত উল্লাহ। তাদের পরিবারে সাহায্যকারী হিসেবে আনোয়ারা বেগম আছেন ৩৬ বছর ধরে।
বর্তমানে ৭০ বছর বয়স আনোয়ারা বেগমের। তাকে নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ করে দিতেই এই ব্যবস্থা করেছেন তারা। কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ায় আনোয়ারা বেগম নিজের পরিবারে কাছে ছিলেন অবহেলিত। মা ছোটবেলায় মারা যান, স্বামী ছেড়ে চলে যান। একমাত্র মেয়েকে দত্তক দিয়ে চলে আসেন কামরুন নাহার ও এন এম শরীয়ত উল্লাহ দম্পতির বাড়িতে। সেই থেকে ৩৬ বছর এখানেই ছিলেন পরিবারের সদস্য হয়ে।
তাহসিনা আফরিন ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘ছোটবেলায় বুঝ হওয়ার পর থেকে জেনেছি আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৭ জন। বাবা, মা, ভাই-বোন, দাদু আর বুয়া। আমাদের বুয়া, আনোয়ারা বেগম আম্মুর কাছে আসেন যখন আমার দাদি বৃদ্ধ, চলৎশক্তিহীন ছিলেন আর তানিয়া একদম নতুন হওয়া বাবু। আম্মু তখনো অনার্সের ছাত্রী। এরপর কেটেছে ৩৬ বছর! বুয়া আমাদের ছেড়ে কোথাও যাননি।’
বুয়া ছিলেন কিছুটা বুদ্ধিতে খাটো এবং খেয়ালি। নানা কারণে স্বামী তাকে পরিত্যাগ করেছিল, একটা মেয়ে ছিল তাকেও পালক দিয়ে দিয়েছিল। ফলে তিনি ছিলেন একা। আমাদের বাসায় কাজে এসেও তিনি আজন্ম নিজের খেয়াল খুশি মতো কাজ করতেন, কাউকেই সেভাবে মানতেন না, সারাদিন পান চিবানো, তুচ্ছ কারণে চেচিয়ে পাড়া জাগানো-এসব ছিল তার স্বভাব! আম্মু কলেজ থেকে ফিরলে আমাদের সারাদিনের কর্মকাণ্ড আম্মুকে জানিয়ে দেওয়ার কারণে ছোটবেলায় বুয়াকে সহ্যই হত না! কিন্তু বড় হতে হতে বুঝেছি, আমাদের বাসায় আসলে বুয়া ছিলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ পিলারের মতন। তাই আম্মু এত শত সমস্যার পরেও বুয়াকে আগলে রেখেছেন। এবং এখন একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে বুঝি, বাসায় একটা বিশ্বস্ত সহচর পাওয়া কত বড় নেয়ামত।
বুয়া এই ৩৬ বছরে কত কি করেছেন আমাদের জন্যে! আম্মু পড়াশোনা শেষ করলেন, বিসিএস দিলেন, আমাদের একটা নতুন ভাই হলো, আম্মু জবে জয়েন করলেন, আমরা স্কুল পেরিয়ে বড় হচ্ছিলাম, ২০০০ সালে দাদি মারা গেলেন, আম্মু চট্টগ্রাম-ফেনী -ঢাকার একাধিক পোস্টিং প্লেসে কাজ করলেন, আর আমাদের ‘আম্মুর বাসা’ আগলে রাখলেন আমাদের বুয়া। যে কোনো সময় মায়ের বাসায় এলেই হত, কারণ দরজা খোলার মানুষটা অন্তত ছিল!
এখন খাগড়াছড়ির রামগড়ে, বুয়ার পরিবার দিনে দিনে আর্থিক ভাবে বেশ সচ্ছল হয়েছেন। তারা বুয়ার খোঁজ খবর নিয়মিত নিতেন। তারা চাইতো না তিনি আর কাজ করুক। এরপরেও আরও দশ বছর বুয়া নিজের আগ্রহেই রয়ে গেলেন আমাদের সাথে। কখনো রুপকথার টানে, কখনো শেহজাদ, আর কখনো আনন্দের বিয়ে দেখে যাবার ইচ্ছেয়।
অবশেষে বুয়ার যাবার সময় হল। শরীরের শক্তি থাকতে থাকতে তাকে তার মত করে বাকি জীবন প্রিয়জনের সাথে থাকার জন্যে আম্মু আব্বু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। বুয়ার পরিবারও তাকে আদরে সাদরে টেনে নিলো।
আমাদের আম্মুর বাসাটা, বুয়ার চেচামেচি-হইচই আর সরব উপস্থিতি বিনে একদম শুনশান শুনায় এখন!গত মা দিবসে আম্মু বুয়ার জন্যে একটা ছোট্ট ফেয়ারওয়েল পার্টির আয়োজন করলেন। ব্যানার বানালেন, আমাদের সবাইকে ইনভাইট করলেন, বুয়ার জন্যে আলাদা করে অনেক গিফট কিনলেন। আমরা সবাই মিলে তার অপরিসীম অবদানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ নিলাম। এরপর স্বজনদের কাছে তাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন আম্মু নিজে। দীর্ঘদিনের সারথিকে বিদায় দিতে আম্মুর চোখে বার বার পানি দেখেছি।
আমাদের বুয়াকে তার গ্রামের লোকজন অপদার্থ ভেবে এক সময় তুচ্ছ করেছে। তার জীবনটা পৃথিবীর কোথাও কোন কাজে লাগবে, কেউ গ্রাহ্য করেনি। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের পাঁচজনের এই পরিবারে বুয়ার কত অবদান, আমাদের দাদির বৃদ্ধ সময়টায় বুয়ার কত অবদান। এমন নিভৃতে অন্যের জীবনে আলো ধরে যাওয়া মানুষগুলোকে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিক। আমাদের আদরের বুয়ার অবসর সময় অনেক ভালো কাটুক।
এমআর