বসুন্ধরা থেকে দুবাই, কানাডা থেকে চট্টগ্রাম- কোথায় নেই হাসান মাহমুদের সম্পদ?
দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন আত্মগোপনে থাকা সাবেক মন্ত্রী ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ। তার স্ত্রী, কন্যা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে-বেনামে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব দেখে রীতিমতো বিস্মিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা।ব্যাংক হিসাবে বিপুল লেনদেন:বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) থেকে আসা ব্যাংক তথ্য অনুযায়ী, হাছান মাহমুদ, তার স্ত্রী নুরান ফাতেমা, কন্যা নাফিসা জুমাইনা মাহমুদ এবং তাদের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে ৭০টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব হিসাবে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য রয়েছে, যেখানে বর্তমানে স্থিতি রয়েছে ২৩ কোটি ৬০ লাখ ৭৪ হাজার ২০২ টাকা।দেশের মেঘনা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, পুবালী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংকে এসব লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকে ১৬টি, মেঘনা ব্যাংকে ১৭টি, এবি ব্যাংকে ৯টি, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে ২টি, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকে ১৮টি, জনতা ব্যাংকে ১টি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ৪টি এবং পুবালী ব্যাংকে ১টি হিসাব রয়েছে।দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রীর আয়কর নথিতে উল্লিখিত আয় এসব সম্পদের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। হিসাব অনুযায়ী, তাদের প্রকৃত সম্পদ অর্জনের হার আয়কর বিবরণীর তুলনায় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার গুণ বেশি।বিদেশে সম্পদ ও সম্পদের উৎস:হাছান মাহমুদ শুধু নিজে নয়, তার ভাই এরশাদ মাহমুদ ও খালেদ মাহমুদের নামেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। তাদের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জমি দখল, বন বিভাগের পাহাড় দখল, বাংলো ও বাগানবাড়ি নির্মাণ, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অট্টালিকা নির্মাণ, আবুধাবির আজমান এলাকায় বিশাল জায়গা নিয়ে রিসোর্ট তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে।দুদকের পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষ টিম এই সম্পদের অনুসন্ধানে নেমেছে। টিমের সদস্যরা ইতোমধ্যে দেশে ও বিদেশে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছেন, যা যাচাই-বাছাই চলছে।রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার:আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে বন ও পরিবেশ, তথ্য ও সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন হাছান মাহমুদ। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান।দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে স্ত্রী নুরান ফাতেমাকে জাহাজ ব্যবসার লাইসেন্স পেতে সহায়তা করেন। তার স্ত্রী ও তার মালিকানাধীন "দি বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস" নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কন্টেইনার ও ফিশিং জাহাজ নির্মাণ করা হয়। তবে চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এফএমসি গ্রুপ থেকে টাকা পরিশোধ না করেই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জাহাজ সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় হাছান মাহমুদ, তার স্ত্রীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।দুদকের তদন্তে আরও জানা যায়, হাছান মাহমুদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী থাকাকালে রাতারাতি তার স্ত্রীকে জাহাজ ব্যবসায়ী বানিয়ে দেন এবং রূপালী ব্যাংক থেকে ১২ কোটি টাকা ঋণ নেন, যা পরিশোধ না করায় সুদাসলে এখন দাঁড়িয়েছে ১৯.৫ কোটি টাকা।ব্যক্তিগত সম্পদের বিশদ বিবরণ:দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, হাছান মাহমুদ ও তার পরিবারের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ছয়টি ব্যক্তিগত ও ৩০টির বেশি যৌথ ব্যাংক হিসাব রয়েছে। মেঘনা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও এবি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় এসব হিসাব খোলা হয়েছে।তার কন্যা নাফিসা জুমাইনা মাহমুদের নামেও চারটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে, যেখানে প্রায় ১.৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে এবং বর্তমানে স্থিতি রয়েছে ৯৬ লাখ টাকা। এছাড়া "দি ডেইলি পিপলস লাইফ" নামে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রকাশক হিসেবে তার নাম রয়েছে, যা হাছান মাহমুদ তথ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে অনুমোদন পেয়েছিল।সম্পদের বিস্তৃতি:দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানবাজার এলাকায় ১৫ তলা ভবনসহ তিনটি বহুতল ভবন, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাড়ি, চট্টগ্রামের সিরাজদৌলা রোডে বাণিজ্যিক ভবন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমান এলাকায় হোটেলসহ স্থাবর সম্পত্তি, কানাডায় একটি বাড়ি, চট্টগ্রামের মাতারবাড়ীতে কয়লাবিদ্যুৎ ও গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্প থেকে অবৈধ লভ্যাংশ গ্রহণের তথ্য পাওয়া গেছে।রাঙ্গুনিয়ায় বন বিভাগের ১৬ দশমিক ১৯ একর জমি দখল করে বাগানবাড়ি নির্মাণের অভিযোগও উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বন বিভাগ ওই জমি পুনরুদ্ধার করে স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করেছে।ব্যাংক হিসাব জব্দ ও আইনি পদক্ষেপ:গত ১৬ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে হাছান মাহমুদ ও তার পরিবারের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। দুদক জানিয়েছে, তার বিরুদ্ধে পাওয়া সম্পদের তথ্য আদালতে উপস্থাপন করা হবে এবং সম্পদ জব্দের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে— অবৈধ সম্পদ অর্জন, বিদেশে অর্থপাচার, জাহাজ নির্মাণের অর্থ পরিশোধ না করা, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ।দুদকের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছে। এমআর-২