শীত নামলেই কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নরসুন্দা নদীতে উড়ে আসে অতিথি পাখি। অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত হয় নদীর পাড়। শহরবাসী তীব্র শীতে রাত কেটে ভোর হয় ঘন কুয়াশার আবরণে। হালকা হিমেল বাতাস জানান দিচ্ছে শীতের কোলাহল। ভোরে শহর জুুড়ে হালকা শৈত্য প্রবাহ বইতে শুরু করে। আর ঠিক এ সময়টাতেই হঠাৎ গত পক্ষকাল ধরে নরসুন্দা নদীর গুরুদয়াল সরকারি কলেজ সংলগ্ন নরসুন্দা নদী এলাকায় ছুটে এসেছে অতিথি পাখির দল। তাদের সাথে মিতালী করতে একাধিক প্রজাতির পরিযায়ী পাখিও দেখা গেছে। সৈয়দ নজরুল ইসরাম চত্বর ও দৃষ্টিনন্দন বেইলি সেতু থেকে অতিথি পাখির কল-কাকলি দেখতে নানা বয়সের মানুষ ভীর করছে। তবে দখল ও দূষণে এই অভয়াশ্রম এখন হুমকির মুখে।
অতিথি পাখির উপস্থিতিতে নরসুন্দার ওই এলাকায় এক অসাধারণ নান্দনিক সৌন্দর্য দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই হাওরের স্বচ্ছ জলের সাথে এ সকল পাখির অদ্ভুত জলকেলিতে নয়নাভিরাম দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রতিদিন হাজারো পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমি মানুষ নদীর বুকে পাখিদের নান্দনিক ওড়াউড়ি অবলোকনের জন্য দলে দলে ছুটে আসছেন। কিন্তু তাদের জন্য নেই উষ্ণ অভ্যর্থনা কিংবা যতো আতিথ্যের আয়োজন। উল্টো দখল ও দূষণের কবলে পড়া এ অভয়ারণ্য এখন হুমকির মুখে। এরপরও অন্য বছরের তুলনায় নরসুন্দার মুক্তমঞ্চে বেড়েছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা।
জানা যায়, নরসুন্দা নদীটিকে দৃষ্টিনন্দন লেকসিটি হিসেবে গড়ে তোলার পর থেকে শীতকালে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছিল এখানে। জানুয়ারি এলেই নরসুন্দার বুক চিরে ভিড় জমাতো হাজার হাজার বালি হাঁসসহ নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। পাখির কাকলিতে ভরে উঠতো আশপাশের এলাকা। আর পাখিদের দেখতে সকাল-বিকেল মানুষের ভিড় জমে নরসুন্দা লেকসিটির মুক্তমঞ্চে। তবে ধীরে ধীরে কমছে পাখির সংখ্যা। হতাশা বাড়ছে প্রকৃতিপ্রেমীদের মাঝে।
পরিবেশবাদীদের দাবি, পরিযায়ী পাখিদের এই অভয়ারণ্য রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয়রাও চান, দখল ও দূষণমুক্ত করে অতিথি পাখিদের জন্য নরসুন্দাকে নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলা হোক।
সোমবার (০৩ ফ্রব্রুয়ারি) নরসুন্দা লেকসিটির মুক্তমঞ্চে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শীতের আমেজে নরসুন্দা নদীর বুকে ভিড় জমিয়েছে দূরদেশ থেকে আসা অতিথি পাখিরা। পাখিদের দল বাঁধা ও উড়াউড়ির দৃশ্য দেখে যে কারো নয়ন জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু নেই উষ্ণ অভ্যর্থনা, বরণ ডালা কিংবা আতিথ্যের আয়োজন। দখল-দূষণে আজ হুমকির মুখে নরসুন্দা নদীর পাখিদের এই অভয়ারণ্য।
নরসুন্দা লেকসিটিতে ঘুরতে আসা রিমা আক্তার বলেন, প্রতিবছর এখানে পরিযায়ী পাখি আসে। অতিথি পাখিরা মুক্তমঞ্চের সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি করে। কিন্ত নদী দখল ও দূষণের কারণে আমরা অতীতের মতো পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি না। প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই দ্রুত নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করা হোক।
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা মেরাজ নাছিম জানান, মুক্তমঞ্চের সাথে নরসুন্দা নদীতে শীত মৌসুমে নানান অতিথি পাখি ভিড় করে। পাখিদের ডুব-সাঁতার ও জলকেলি দেখতে ভালো লাগে। তবে কচুরিপানার জন্য এ পাখি ভালো ভাবে দেখা যায় না। আমরা স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাই যেন মুক্তমঞ্চের আশপাশ পরিস্কার করে অতিথি পাখিদের আতিথিয়েতার সুযোগ করে দেয়।
পরিবেশবিদ ও অধ্যাপক মো. রেহাস উদ্দিন বলেন, পরিযায়ী পাখিদের এ অভয়ারণ্য রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। গত বছর আমি নিজ উদ্যোগে মুক্তমঞ্চের উত্তর পাশের কিছু অংশ পরিষ্কার করেছিলাম। সেখানে পাখিরা ডুব-সাঁতার ও জলকেলি করতে পারতো। এবার সে ব্যবস্থা নেই। দখল ও দূষণমুক্ত করে পাখিদের জন্য নরসুন্দাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশাসনে কাছে দাবি জানাই।
এ বিষয়ে গুরুদয়াল সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমি বেশ কয়েক বছর ধরে পরিযায়ী পাখি লক্ষ্য করছি। অন্য বছরের তুলনায় পাখির সংখ্যা এ বছরে বেড়েছে। কারণ কচুরিপানার কারণে অনেকেই বড়শি ও জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারছে না। তাই পাখিরাও এ সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে কচুরিপানার থেকে খাবার গ্রহণ ও এখানেই ডিম দিতে পারছে।
তিনি আরও বলেন, মুক্তমঞ্চের কিছু অংশ পরিষ্কার করলে পাখিদের ডুব-সাঁতার ও জলকেলি করতে সুবিধা হবে। প্রকৃতিপ্রেমীরাও তা উপভোগ করতে পারবেন। পাখিরা শুধু নরসুন্দার মুক্তমঞ্চের সৌন্দর্যই বাড়ায় না, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, নরসুন্দা নিয়ে পরিকল্পনা ও সমীক্ষার কাজ চলমান রয়েছে। এ সমীক্ষার ভিত্তিতে খুব দ্রুতই প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিল করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নরসুন্দা নদীতে পানির প্রবাহ ফিরে আসবে।