জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষার্থী ময়নুল হক। তবে তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক চরম আর্থিক সংকট। ছেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় খুশির পরিবর্তে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে সদ্য স্বামী হারা গৃহিণী মায়া বেগম।
ময়নুল হকের বাড়ী কুড়িগ্রামের সীমান্তঘেঁষা ফুলবাড়ী উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিলুপ্ত ছিটমহলের দাসিয়ারছড়া দোলাটারী। ময়নুল হক ২০২২ সালে গংগারহাট এম এ এস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ ও ২০২৪ সালে ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ উত্তীর্ণ হয়।
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) দুপুরে মেধাবী শিক্ষার্থী ময়নুল হকের বাড়ীতে গিয়ে দেখা গেছে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও সদ্য বাবাকে হারিয়ে ভর্তি ও পড়াশুনা কিভাবে চালিয়ে যাবে এই দুচিন্তায় দিন পাড় করেছে মেধাবী শিক্ষার্থী ময়নুল হক ও তার মা মায়া বেগম। মাত্র তিন শতক জমিতে জরাজীর্ণ টিনসেট ঘর। সেই ঘরে এক পাশে থাকেন মা মায়া বেগম ও ছোট বোন লুৎফা খাতুন এবং এক পাশে থাকে ময়নুল হক ও তার ছোট ভাই মেরাজ।
ময়নুল হকের বাবা লুৎফর রহমান একজন দরিদ্র ইটভাটার শ্রমিক। লুৎফর রহমান ইটভাটায় কাজ কাম করে স্ত্রী দুই ছেলে ও এক মেয়ের ভরনপোষণ চালিয়েছেন। শত কষ্টে মাঝেও তিন সন্তানের পড়াশোনার কোন যেন ক্রুটি না হয় সে ব্যাপারে ছিলেন খুবই সজাগ। অভাব আছে কিন্তু ছেলে-মেয়েদের কখনও বুঝতে দেননি তিনি। বড় ছেলে ময়নুল হক এসএসসি ও এইচএসসি পড়াশুনা অবস্থায় প্রাইভেট পড়াতেন। অনেক সময় নিজের পড়াশুনার খরচ ও পোশাক পরিচ্ছদ নেয়ার পাশাপাশি বাবার সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতে প্রায় সময় দিন মজুরীর কাজও করতেন মেধাবী শিক্ষার্থী ময়নুল হক। বর্তমানে সংসারের একমাত্র উপার্জন ব্যক্তি লুৎফর রহমানকে সদ্য হারিয়ে ওই পরিবারটি চরম দুচিন্তায় পড়েছেন। বিশেষ করে সদ্য স্বামী হারা মা মায়া বেগম বড় ছেলে ময়নুল হকের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খরচ, পরবর্তীতে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া ও এরপর ছোট ছেলে মেরাজ (সপ্তম শ্রেণী) এবং ছোট মেয়ে লুৎফা খাতুনের পড়াশুনাসহ ভরনপোষণ চালিয়ে যাওয়া নিয়ে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন।
মা মায়া বেগম জানান, কি বলবো ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বাহে! এতোদিন আমার স্বামী সীমিত আয় হলেও আমার দুই ছেলে এক মেয়ের ভরনপোষণ ও পড়াশোনার খরচ চালিছেন। বড় ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে আমার স্বামীর ব্রেইন টিউমার রোগে আক্রান্ত হয়। তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর মাত্র তিন শতক জমিতে বাড়ি চালা। কোন প্রকার আবাদি জমি ছিল না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারপরও অনেক কষ্টে একটি দুই গরু, আদা বিঘা জমি বন্দক নেওয়া ছিল। স্বামীর চিকিৎসার জন্য সেই দুটি গরু বিক্রি ও বন্ধকী জমির টাকা ফেরত নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছে। তারপরেও টাকার অভাবে স্বামীর ভালো চিকিৎসা করাতে না পাড়ায় স্বামীকে বাঁচতে পারিনি। ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস। যেদিন বড় ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির রেজাল্ট আসে, সেইদিন বড় ছেলে ঢাকায় থেকে তার অসুস্থ বাবাকে ফোন করে বলেন বাবা আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। তখন তার বাবা ছেলের খুশীর খবরটা শুনে তাকে অনেক দোয়া করেন, তুই অনেক বড় মানুষ হও বাবা। এভাবে বলে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আমার স্বামী। ছেলেও তার বাবাকে বলে বাবা কোন চিন্তা করো না বাবা তুমি সুস্থ হবে। কিন্তু ভাগ্যে কি নিমর্ম পরিনিতি ছেলের রেজাল্টের রাতেই আমার স্বামী এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন। এখন কি করবো জানি না। গরীব ঘরে জন্ম নেয়া ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পাওয়া আমাদের জন্য খুই বড় গর্বের। কিন্তু ছেলে স্বপ্ন পূরণে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও পড়াশোনার বিপুল খরচ মেটানো এখন আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। ছেলের কাছে শুণলাম ৫ মে ভর্তির শেষ তারিখ। ঘরে একটি কানা-কড়িও নেই। তিনি তার মেধাবী ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও পড়াশুনার খরচ চালানো জন্য সরকারসহ বিত্তবানদের সহযোগিতা চেয়েছেন।
মেধাবী শিক্ষার্থী ময়নুল হক বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। বাবা অনেক কষ্ট করে ইটভাঙায় শ্রমিকের কাজ করে আমার পড়াশুনার খরচ চালিয়েছেন। আমিও বাবার সংসারে সহযোগিতা ও পড়াশোনার পাশাপাশি কখনও প্রাইভেট ও মানুষের জমিতে দিন মজুরীর কাজও করেছি। হঠাৎ এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। ছোট সংসারে যা কিছু ছিল সবেই বাবার চিকিৎসায় ব্যয় হয়েছে। বাবা-মার অনুরোধে অসুস্থ বাবাকে বাড়িতে রেখে মানুষের কাছে ধার-দেনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির কোচিং করতে ঢাকায় এসেছি। ঢাকায় যে ম্যাচে ছিলাম সেখানে এক বেলা খেয়ে টানা এক মাস অভাবের কারণে রোজা করেছি। এক মাস পর ম্যাচে থাকা ভাইয়েরা জানতে চাই, আমি কেন রোজা রাখছি। তখন আমি বলেছি ম্যাচে তিন বেলা খাওয়ার টাকা নেই। তাই রোজা করছি ভাই। তুমিতো দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন তারা বলে এখন আর রোজা রাখার দরকার নেই। তোমার খাওয়া খরচ আমরায় চালাবো। তখন ভাইদের কথায় আর রোজা রাখা হয়নি। তারাই আমার খাওয়ার খরচ দিয়েছি। সেখানে থেকেই আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দেই। যেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির রেজাল্ট হয়, সেইদিন বাবা-মাকে ফোনে জানাই। বাবা-মাসহ বাড়ির সবাইকে বলি আমি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫৮ তম হয়েছে। (ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছি)।বাবা মাসহ পরিবারের সবাই খুশি হয়েছেন। তবে কথা বলার সময় বাবা অনেক কেঁদেছেন এবং আমাকে দোয়াও করেছেন। কি নিমর্ম পরিহাস সেইদিন রাত ৪ টায় বাবার মৃত্যুর খবর পাই। এক দিকে বাবাকে হারালাম অন্য দিকে অর্থের অভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবো কি অনেক দুচিন্তায় পড়েছি। এই মুহূর্তে আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির খরচ জোগানো সম্ভব না। ভর্তির সর্বশেষ তারিখ আগামী ৫ মে। ভর্তিসহ পড়াশোনার খরচ বহন করার জন্য সরকারসহ বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন মেধাবী শিক্ষার্থী ময়নুল হক। তিনি আবারও সবার কাছে সাহায্যের আবেদন জানাছেন। তিনি আরও জানান, মহান আল্লাহ অশেষ কৃপায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। আমি ভবিষ্যতে গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে চাই।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেহেনুমা তারান্নুম জানান, ওই মেধাবী শিক্ষার্থীর ঠিকানা জানা নেই। তারপরও খোঁজ খবর নিচ্ছি এবং ওই শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করা হবে বলে আশ্বাস দেন ইউএনও।
এইচএ