বাড়ির ছাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ভ্রাম্যমান বিক্রেতার কাছ থেকে শখ করে কয়েকটি ক্যাকটাস প্রজাতির চারা কিনে সেগুলো প্রথম টবের মধ্যে রোপন করা হয়। গাছের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শখ দুটি জিনিসকে পুঁজি করে সেখান থেকে ধীরে ধীরে কয়েক রকমের ফুলের গাছ ও সবজি চাষে ব্যাপক সফলতা পেয়ে ছাদবাগান করার চিন্তা-ভাবনা। শখের বসে করা সেই ছাদবাগানই এখন আয়ের অন্যতম পথ এবং একজন নারীকে পরিনত করেছে সফল উদ্যোক্তায়। বলছিলাম পাবনার ঈশ্বরদী পৌর শহরের পোষ্ট অফিস মোড় এলাকার বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌস জুথির কথা। যিনি অল্প কিছু গাছ দিয়ে ছাদবাগান করার যাত্রা শুরু করলেও বিগত চার বছরের ব্যাবধানে সেই ছাদবাগানেই এখন রয়েছে শোভাবর্ধনকারী দেশি-বিদেশি দুর্লভ তিন শতাধিকেরও বেশি ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট প্রজাতির গাছ। যেখান থেকে অনলাইন অফলাইনে গাছের চারা বিক্রি করেই তিনি মাসে আয় করছেন ৩০-৪০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, ২০২০ সালে সংসার খরচ থেকে জমানো ১২০০ টাকা দিয়ে শখ করে নিজ বাড়ির ছাঁদে কয়েকটি টবে সাকুলেন্ট, চায়নিজ ডান্স ক্যাপ, ডলফিন ও বানানা সহ বেশ কয়েক প্রজাতির ক্যাকটাস গাছের চারা রোপন করেন জুথি। পরবর্তীতে ২০২১ সালে করোনাকালীন সময়ে অবসর সময় কাটাতে শখের বসে করা সেই ছোট ছাদবাগানের পরিধি বাড়াতে আরো কয়েক প্রজাতির ক্যাকটাস ও অন্যান্য গাছ লাগান তিনি। বিগত চার বছরে জুথির তৈরি এ ছাদবাগান রুপ ধারন করেছে বৃহৎ আকারে সংগ্রহে রয়েছে এঞ্জেল উইং, ক্রিসমাস, লেডিফিঙ্গার, প্যারোডিয়া, ব্যারেল, চাঁদ, অ্যালো, ঘৃতকুমারী ও ঘৃতকাঞ্চন, জেব্রা প্ল্যান্ট, এচিভেরিয়া, এয়ার প্ল্যান্ট, স্যানসেভিরিয়া, পাথরকুচি, কাঁটামুকুট সহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন ধরনের তিন শতাধিকের বেশি ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট গাছ। বর্তমানে এ ছাদবাগানে প্রায় ২ লাখ টাকার গাছ রয়েছেন বলে জানান উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস জুথি। শখ থেকে শুরু হলেও এই ছাদ বাগান এখন জুথির আয়ের একটি উৎস। তবে চারা বিক্রির এসব টাকা তিনি অন্য কোথাও ব্যয় না করে বাগান বৃদ্ধিতেই কাজে লাগাচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ছাদের পুরো অংশজুড়ে স্টিলের তৈরি র্যাকের উপর সাজানো লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ, সবুজসহ নানা রঙ্গের ক্যাকটাস ও বিভিন্ন প্রজাতির চারা ও গাছ। সেগুলো যত্ন নিতেই ব্যাস্ত সময় পার করছেন জুথি। শোভাবর্ধনকারী এ ছাদবাগান দেখতে এলাকার অনেকেই ছুটে আসছেন জুথির বাগানে। এমনই কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জুথির এ ছাদবাগানের সৌন্দর্য নিয়ে বলেন, আমরা চিন্তাও করতে পারিনি আমাদের একজন প্রতিবেশি এলাকার মধ্যে দেশি-বিদেশি গাছের সমারোহে এত সুন্দর ছাদবাগান করবেন। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে জুথির উদ্যোগে তৈরি এ ছাদবাগান সেরার মধ্যেও সেরা। আমাদের কাছে খুব ভালো লাগে। আমরা মাঝে মধ্যেই দেখতে আসি। আমরা চাই একজন নারী হিসেবে জুথির যে সফলতা তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক।
উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস জুথি বলেন, অনেক আগে থেকেই শখের বসে ছাদের উপর বিভিন্ন গাছ রোপন করতাম। করোনাকালীন সময়ে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় গাছগুলোর সাথেই বেশি সময় কাটিয়েছি। যার কারনে এদের প্রতি একটা আলাদা ভালোবাসা ছিল। গাছ লাগানোর পর গাছের দ্রুত সময়ে বৃদ্ধি দেখে বাগান করার পরিকল্পনাটি মাথায় আসে। প্রথমে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অনলাইন থেকে ক্যাকটাস ও সাকুলেন্ট জাতের অল্প কিছু চারা সংগ্রহ করি। তবে সময়ের সাথে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে বিনিয়োগ ও চারা সংগ্রহ। বর্তমানে দেশি-বিদেশী প্রায় সাড়ে তিন শতাধিকের বেশি জাতের চারা রয়েছে আমার বাগানে। তবে আজকের ছাদবাগান তৈরি ও একজন সফল উদ্যোক্তা হতে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে আমার স্বামী এনামুল হক। বর্তমানে অনলাইন অফলাইনে সব মিলিয়ে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমার এ বাগানের চারা বিক্রি করছি।
জুথি আরও বলেন, আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের স্বাবলম্বী করতে সব সময় একটা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। সকলের বাহিরে চলাফেরার সুযোগ হয় না। বাড়িতে থেকে যারা নিজেরা স্বাবলম্বী হতে চায়, এই উদ্যোগ সেসকল নারীদের সাবলম্বী হতে আরও উৎসাহ দেবে। আমার মত যারা বাগান তৈরিতে আগ্রহী আমি তাদের সব সময় পরামর্শ ও চারা সংগ্রহে সহযোগিতা করবো।
জুথির স্বামী এনামুল হক বাবু বলেন, অনেক আগে থেকেই গাছের প্রতি আমার স্ত্রীর একটা দুর্বলতা কাজ করতো। তার ছাদবাগানের সৌন্দর্য দেখে আমারও ভালো লাগে। তাই আমি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গাছের চারা সংগ্রহ করে দিই। বাগানটিতে বেশিরভাগ সময় আমার স্ত্রী পরিচর্যা ও দেখাশোনার কাজ করে পাশাপাশি আমিও সহযোগিতা করি। এখন বাণিজ্যিকভাবে রূপ নেওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতারা অর্ডার করে থাকেন। চারা গুলো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার স্ত্রীকে সহযোগিতা করি। কেউ যদি ছাদবাগান করে উদ্যোক্তা হতে চাই তবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে তাকে পরামর্শ ও চারা সংগ্রহে সহযোগিতা করবো।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার বলেন, কৃষিতে বৈচিত্র্যময় একটি উপজেলা ঈশ্বরদী। দিন যত যাচ্ছে কৃষিতে নতুন নতুন সংযোজন আসছে। বর্তমান সময়ে কৃষিতে একটি জনপ্রিয় উপায় হচ্ছে ছাদকৃষি। শহরে বসবাসরত অনেকেই এ ছাদকৃষিতে সংযুক্ত হচ্ছেন। তেমনি ঈশ্বরদীতেও একটি ব্যাতিক্রমী ছাদবাগান করেছেন জান্নাতুল ফেরদৌস জুথি নামের এক নারী উদ্যোক্তা। যেখানে ক্যাকটাস জাতীয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রয়েছে। তার এরকম উদ্যোগ একদিকে যেমন প্রশংসনীয় অন্যদিকে অনুপ্রেরণাদায়ক। জুথির এ ছাদবাগানের সম্প্রসারন আরো বৃদ্ধি করতে ও অন্য কেউ যদি এরকম ছাঁদবাগান করে সাবলম্বী হতে চাই তাদের আমরা পরামর্শ দিয়ে সার্বিক সহায়তা করবো।
এইচএ