বাবা গতবছর কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাইছিলাম। এর পর আজ পর্যন্ত একটা কুডি (টুকরো) খাইতারলাম না ৷ আগামী কোরবানির অপেক্ষায় তাকিয়ে আছি। এইবার রোজার ঈদেও একটু ভালো খাওন (খাবার) পাইনি।
মাইনসে কিছু সেমাই দিছিলো কিন্তু জন্মদাতা ছেলেরা আমারে কিছুই দেয়না কোন সময়ই৷ ঈদেও কিছু দিলো না ৷ তারা দিলে মনডায় শান্তি লাগতো৷ তবুও তারা সুখী হউক। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এবং আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষক জাহানারা (৬৫)।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের পূর্বচর পাড়াতলা গ্রামে তার বাড়ি৷ বিগত বিশ বছর ধরে কর্ম অক্ষম হয়ে ভিক্ষার থলি হাতে নিয়েছেন বৃদ্ধ জাহানারা। বয়সের ভাড়ে শরিল নুইয়ে পড়েছে। একটি ব্যাগ আর লাঠি ভর দিয়ে গোঁজা হয়ে হেটে চলছেন কটিয়াদী বাজারের পথে পথে এই দোকান থেকে ওই দোকানে।
জাহানারার সাথে কথা বলে জানা যায়, সংগ্রামের দুইবছর পর বিয়ে হবার পর থেকে টেনেটুনে চলেছিলো সংসার। স্বামী অলস প্রকৃতি ও ভবঘুরে হওয়াতে কোন সময়ই সংসারে স্বচ্ছলতা আসেনি৷ অভাবের কারণে একসময় তিনিও মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন৷ পরে স্বামী সফর উদ্দিনও (৭৫) অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন৷
বয়সের কারণে মানুষ কাজে নেয়না৷ বাধ্য হয়ে ভিক্ষা শুরু করেন জাহানারা৷ যা আজ-অব্দি বিশ বছর হতে চলেছে। জাহানারা, সফর উদ্দিন দম্পতির দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। তারা সবাই পরিবার নিয়ে সংসার করছেন৷ কেউ মা বাবার খোঁজ নেয়না৷ মেয়েরা মাঝেমধ্যে খোঁজ নিলেও ছেলেরা একদমই নেয়না৷ জাহানারার নামে একটু জমি ছিলো এগুলো ছেলেরা লিখে নেয়৷ বর্তমানে পিতামাতা বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ঝোপঝাড় সংলগ্ন কবরস্থানে ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন৷ বেঁচে থাকার পরেও কবরস্থানই যেনো হলো পিতা-মাতার আপন ঠিকানা। বৃষ্টি হলে ঘরে পরে পানি আর রাত হলেই শিয়াল আর বন্য প্রাণীর শব্দে এভাবেই রাত কাটে তাদের৷
তার সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, গত কোরবানির ঈদে মানুষের দেওয়া গরুর গোশত খেয়েছেন৷ এরপর থেকে ইচ্ছে হলেও কাউকে বলার ও কিনে খাওয়ার কোনটাই সম্ভব হয়নি৷ মাঝে মধ্যে মানুষের দেওয়া মুরগি পেলেও অন্য গোশত তাদের জন্য স্বপ্ন হয়ে থাকে৷ তাই সারাবছর কোরবানির সময়কার অপেক্ষায় থাকেন তারা৷ সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবার কটিয়াদী বাজারে ভিক্ষা করতে আসেন। পাঁচ থেকে ছয়শত টাকা হয়৷ বয়স্ক ভাতা পান তা দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সপ্তাহের স্বামী স্ত্রীর খাবার খরচ মিটাতে হয়৷
বৃদ্ধ জাহানারা সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন, 'তিনটা ছিঁড়া কাপড় দিয়ে বছর পার করছি৷ এবার ঈদে একটি কাপড়ও পাইনি। ফেতরার দানের আড়াইশ টাকা শুধু পাইছি৷ মানুষ মাঝে মধ্যে খাইতে দেয়। কখনো কিছু সহযোগিতাও করে কিন্তু তা মাঝেমধ্যে। বাকি দিনগুলো কেমনে পার করি, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা কিছু।'
এমআর