চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়ায় আইনের প্রতি কোনো সম্মান বা ভয় না রেখেই, প্রশাসনের নীরবতার সুযোগ নিয়ে দিব্যি পুকুর ভরাটের মহোৎসব চলছে। কালামিয়া বাজারের প্রাণ, আবদুল লতিফ হাটখোলা কালভার্টের পাশের পুকুরটি দিনে দিনে মাটির স্তূপে পরিণত হচ্ছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এটি যেন আইনের শাসনকে চোখ রাঙানোর নগ্ন প্রদর্শনী।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই এলাকার আলী হোসেন মাস্টার বাড়ির জলাধার—যেটি একসময় এলাকার মৎস্য উৎপাদনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল—তা আজ ক্ষমতার দম্ভে মাটি চাপা পড়ছে।
আলী হোসেন মাস্টারের ছেলে, আওয়ামী লীগ নেতা নাছির, দিনদুপুরে খাল থেকে উত্তোলিত ময়লা ও মাটি এনে পুকুরটি ভরাট করছেন। কাজে লাগানো হয়েছে ৪-৫টি ড্রাম ট্রাক, যেন এলাকাবাসীর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও বুলডোজারের নিচে পিষে ফেলা হয়।
তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিবেদকসহ কয়েকজন সংবাদকর্মী সেখানে গেলে নাছির বাড়ি থেকে বের হয়ে বলেন, এটি তার ব্যক্তিগত পুকুর। ভরাট করা দোষের কিছু নয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তার নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তার ছেলে আরিফ ঢাকা প্রেসক্লাবের সদস্য। তিনি আপনাদেরকে ফোন দিলে বুঝবেন ‘খেলা’।
এসময় তিনি আবার হঠাৎ সুর পাল্টিয়ে বলেন, এই মাসের মধ্যে খালের সব মাটি সরানোর নির্দেশ থাকায় কয়েকজন সেনা অফিসার অনুরোধ করেছেন, তাই মাটি পুকুরে ফেলছেন, পুকুর ভরাটের কোনো পরিকল্পনা তার ছিল না।
যেই কারণেই হোক না কেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্ব অনুমতি ছাড়া পুকুর ভরাট করা বেআইনি—এমন কথার জবাবে নাছির উত্তেজিত হয়ে বলেন, "যা খুশি করেন, নিউজ করেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদেরকে আমি ম্যানেজ করবো। আমার ভাই সালাহউদ্দিন আইনজীবী, উল্টো পরিবেশ অধিদপ্তরকে আমরা আইন দেখিয়ে দেবো।"
এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জজকোর্টের এডভোকেট মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ হোসাইনী ‘সময়র কণ্ঠস্বর’-কে বলেন, 'বাংলাদেশ জলাধার সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫' এবং 'প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০'-এর স্পষ্ট বিধান অনুযায়ী, কোনো প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট সম্পূর্ণ বেআইনি।
আইনের ৫ ধারা বলছে, জলাধারের শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্যভাবে ব্যবহার নিষিদ্ধ। কেউ এ আইন ভঙ্গ করলে, ৮ ও ১২ ধারায় সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।
অথচ কালামিয়া বাজারের এই প্রভাবশালী ব্যক্তি প্রকাশ্য দিবালোকে আইনের সেই বিধানকে তামাশায় পরিণত করেছেন।
কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, নাছির আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং খুবই উশৃঙ্খল প্রকৃতির লোক। তিনি এলাকাবাসীর কোনো মতামতকে সমর্থন কিংবা পাত্তা দেন না।
অত্র এলাকার সাবেক কাউন্সিলর হারুনের বিশ্বস্ত এই সহযোগী নাছির জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের সনাক্তকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় এলাকাবাসীকে অনেক হয়রানি করেছেন।
এই পুকুরটি সৌন্দর্য বর্ধনসহ এলাকাবাসীর অনেক উপকারে এসেছে। বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণেও এই পুকুরটির ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
তাদের মালিকানাধীন পুকুর তারা ভরাট করছে—সেখানে আমাদের তো বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর যদি ব্যবস্থা নিতো, তাহলে পুকুরটি রক্ষা করা যেতো।
খাল সংস্কার প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মোঃ আহাদুজ্জামান 'সময়র কণ্ঠস্বর'-কে বলেন, "আমরা কোনোভাবেই উনার পুকুরে মাটি ফেলছি না। বরং উনিই অনুরোধ করেছেন খালের মাটি তার পুকুরে ফেলার জন্য।"
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া পুকুরে মাটি ফেলা বেআইনি নয় কি—এমন প্রশ্নের জবাবে আহাদুজ্জামান জানান, এখন থেকে আর মাটি ফেলা হবে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর পরিচালক সোনিয়া সুলতানা 'সময়র কণ্ঠস্বর'-কে জানান, "পুকুর ভরাটের কোনো সুযোগ নেই। আমরা দ্রুত সরেজমিন তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।"
এনআই