নীলফামারী উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিকদের সঙ্গে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ভেনচুরা লেদার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের মো. হাবিব (২১) নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৬ জন শ্রমিক।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে উত্তরা ইপিজেডের মূল গেটের সামনে এই সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। তবে সংঘর্ষ থামলেও এলাকাজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সংঘর্ষের ঘটনায় বর্তমানে নীলফামারী-সৈয়দপুর মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সংঘর্ষে নিহত হাবিব ওই ইপিজেডের ইকো কোম্পানিতে কাজ করতেন। হাবিব নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশী ইউনিয়নের কাজিরহাট গ্রামের দুলাল হোসেনের ছেলে।
শ্রমিকরা জানান, মোট ২৩ দফা দাবি নিয়ে গত শনিবার থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন তারা। প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, জেনারেল ম্যানেজারের পদত্যাগ, পুরাতন শ্রমিকদের ছাটাই বন্ধ করে পূর্বের লেঅফ সিস্টেমে ফেরত আনা, নামাজের সময় নিশ্চিত করা, স্যালারি কার্ড বাতিল, কোনো শ্রমিক স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে লেঅফ পদ্ধতিতে বের করতে হবে, পুরাতন শ্রমিকদের পূর্বের আইডিতে পুনর্বহাল করা সহ ২৩টি দাবিতে আন্দোলন করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে শ্রমিকরা ইপিজেড গেটে প্রবেশ করতে গেলে সেনাবাহিনী সেখানে অবস্থান নেয়। এ সময় এক পর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। পরে গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে সেনাবাহিনী।
এ বিষয়ে নারী শ্রমিক আখি আক্তার বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনের মতো সকালে অফিসে যাই। গিয়ে দেখি গেট বন্ধ, সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমরা নারী শ্রমিকরা পড়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কারও খোঁজ নেওয়া হয়নি। আর আমাদের ভাইয়েরা যদি কোম্পানির ক্ষতি করতো, তাহলে সেটা আলাদা বিষয় ছিল। কিন্তু কোনো ক্ষতি না করেও সাধারণ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালানো হলো কেন? সেনাবাহিনী যে গুলি চালালো, তারা কার অনুমতি নিয়ে গুলি চালালো আমরা সেটা জানতে চাই। আমাদের এখন একটাই দাবি, সেনাবাহিনী গুলি চালালো কোন অনুমতিতে, তা জানাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এভারগ্রীন কোম্পানিতে কাজ করি। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের একটি নিয়ম থাকে, কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করলে তাকে নির্দিষ্ট একটা পরিমাণ টাকা দিয়ে বের করে দিতে হবে। কিন্তু এখানে তা করা হয়নি। হঠাৎ করেই বের করে দেওয়া হচ্ছে। আমি একটি প্রতিষ্ঠানে ১০ বছর ধরে চাকরি করছি, অথচ কোনো টাকা-পয়সা না দিয়ে আমাকে যদি বের করে দেওয়া হয়, তবে সেটা কী অন্যায় নয়? আমরা ন্যায্য বেতন-ভাতা চাই, সেটি আমাদের দিতে হবে।’
অন্যদিকে শ্রমিক সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নাইট ডিউটি শেষে সকাল ছয়টা দশ মিনিট পর্যন্ত ভেতরে ছিলাম। তখনও গেট খোলা ছিল। এর মধ্যে সেনাবাহিনী ভেতরে প্রবেশ করে গেট বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকলে সেনারা বলে আজ ৫ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটবে। আমি সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলাম। আমরা সবাই একটাই কথা বলেছি, আমাদের দাবি মেনে নিতে হবে। অভিযোগ দেওয়ার তিন দিন পার হলেও এখনো কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো জবাব আসেনি। সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেও জানিয়েছিলাম, ব্যাপজা ও এভারগ্রীন কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার এসে আমাদের দাবির কাগজ হাতে নিলেই আমরা সরে যাবো।’
সংঘর্ষের মূল কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতে মাইকিং করা হয়েছিল যে এভারগ্রীন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। অথচ মাসের প্রথম তারিখে যে বেতন দেওয়ার কথা, সেই বেতন দেওয়া হয়নি। দুই মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। তারা বলছে অফিস বন্ধ, অথচ তাদের নিজস্ব লোকজন ভেতরে প্রবেশ করছে আবার বেরও হচ্ছে। আমাদের শ্রমিকদের সমস্যা হলে আমরা কোথায় বিচার চাইবো? ব্যাপজার কাছে অভিযোগ দিলে কোনো সমাধান পাই না। যে গিয়ে অভিযোগ করে, তার চাকরি থাকে না। আমরা যে শ্রম দেই, সেটা কি শ্রম নয়? আমরা কি ন্যায্য বিচার পাব না?’
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. তানজিরুল ইসলাম ফারহান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘মৃত অবস্থায় হাবিবকে হাসপাতালে আনা হয়। তার বুকে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয়।’
নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম. আর সাঈদ সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কতজন নিহত হয়েছেন তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কেউ বলছে একজন, আবার কেউ বলছে দুইজন। আমরা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছি। পরবর্তীতে সঠিক তথ্য পাওয়া গেলে জানানো হবে।’
এআই