চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া ইউনিয়নে উদ্বোধনের আগেই ফাটল ধরেছে একটি নতুন ব্রিজে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের আওতায় নির্মিত এ ব্রিজের জন্য সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হয়েছে ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫১ টাকা। অথচ গাড়ি ওঠার আগেই ফাটল ধরা পড়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা নিয়ে তীব্র প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয়দের ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
সরেজমিনে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ব্রিজটির কাজ নির্ধারিত সময়ে না হয়ে শুরু হয় ভরা বর্ষা মৌসুমে। এতে নির্মাণের মৌলিক শর্তই লঙ্ঘন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, নির্মাণ কাজে যথাযথ মানের কংক্রিট, বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি।
এলাকার এক বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম জানান, ‘নির্মাণকাজে এমন নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার হয়েছে যে প্রথম বৃষ্টিতেই ফাটল ধরা পড়বে, তা বোঝা যাচ্ছিল।’
অন্য বাসিন্দা নাজমুলের বলেন, ‘এটি কেবল নিম্নমানের কাজ নয়, জনগণের করের টাকার সরাসরি লুটপাট।’
জানা যায়, সরকারি নীতিমালায় উপ-ঠিকাদারি নিষিদ্ধ হলেও, এ ব্রিজ নির্মাণে মূল দায়িত্ব পাওয়া মের্সাস চৌধুরী ইন্টারন্যাশনাল কাজটি দেন স্থানীয় মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক চরম্বা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিন হেলালী।
চৌধুরী ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ হানিফ সময়ের কন্ঠস্বর-কে এ বিষয়ে স্বীকার করে বলেন, ‘কাজটি আমি পেয়েছিলাম, কিন্তু জসিম উদ্দিন মেম্বারকে দিয়েছি। এখন কোনো সমস্যা হলে তিনিই সমাধান করবেন।’
অর্থাৎ সরকারি অর্থায়িত এ প্রকল্পে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব কেবল নামেই ছিল; কার্যত কাজ হয়েছে ইউপি সদস্যের হাতে।
ফাটল ধরা পড়ার পর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নাহিদ আহমেদ জাকির দাবি করেছেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন এবং ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করবেন। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, নির্মাণকাজ চলাকালীন পর্যায়ে কোনো তদারকি করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে–যদি প্রকল্প কর্মকর্তারা যথাযথ তদারকি করতেন, তবে উদ্বোধনের আগেই কেন ফাটল ধরবে?
অন্যদিকে ইউপি সদস্য জসিম উদ্দিন ঘটনাটিকে ছোট করে দেখিয়ে বলেন, ‘সামান্য ফাটল হয়েছে, মূল ব্রিজে নয়। প্রয়োজনে মেরামত করা হবে।’
কিন্তু প্রকৌশল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্বোধনের আগেই যদি ফাটল ধরা পড়ে, তবে এটি কেবল সামান্য ত্রুটি নয়; পুরো কাঠামোর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন।
এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মাত্র দুই মাস আগে একই উপজেলার চরম্বা ইউনিয়নে উদ্বোধনের আগেই আরেকটি ব্রিজ ফেটে পড়ে। সেখানেও অভিযোগ উঠেছিল নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের। এবার একই ধরণের ঘটনা ঘটায় স্থানীয়রা বলছেন–এ যেন ‘একই নাটকের পুনরাবৃত্তি।’
উপজেলায় বারবার একই ধরণের ঘটনা প্রমাণ করছে–সরকারি প্রকল্পে পরিকল্পিত দুর্নীতি হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইউপি সদস্য বা রাজনৈতিক পরিচয়ের জোরে সরকারি প্রকল্প নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিচ্ছেন। তারপর তড়িঘড়ি করে নিম্নমানের কাজ শেষ করে কোটি টাকার সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করছেন।
লোহাগাড়া উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘এখানে দুই ধরনের চক্র কাজ করে–প্রভাবশালী স্থানীয় প্রতিনিধি যারা কাজ বাগিয়ে নেয়, আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যারা কমিশন নিয়ে চোখ বন্ধ রাখেন। ফল ভোগ করে সাধারণ মানুষ।’
এ ঘটনায় সাধারণ মানুষের দাবি স্পষ্ট–ব্রিজটি পুনর্নির্মাণ করতে হবে এবং দায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আরডি