পাবনার ঈশ্বরদীতে জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের তিনতলা বিশিষ্ট একটি নির্মাণাধীন সরকারি ভবনের কাজ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘ সময়। তিন বছরে কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বর্তমানে ভবনটির নির্মাণকাজ বন্ধ করে লাপাত্তা রয়েছেন ঠিকাদার, যার ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের আওতাধীন এ কাজগুলো শেষ হচ্ছে না। ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকায় চরম অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হতে শুরু করেছে রডসহ গুরুত্বপূর্ণ সব মালামাল। এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ঠিকাদার বলেন, 'ফান্ড না দিলে কি বাড়ির জমি বিক্রি করে এনে ভবন নির্মাণ করে দিব?'
জানা গেছে, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণীসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) তত্ত্বাবধানে ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনতলা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। কাজটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বার্ডস কনস্ট্রাকশন ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শুরু করে। কাজ শেষ করে ভবনটি কর্তৃপক্ষের কাছে ২০২৩ সালের নভেম্বরে হস্তান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু কাজটি শুরু করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় কয়েকজন সাব-ঠিকাদারের কাছ থেকে ইট, বালু ও পাথর নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু কয়েক মাস কাজ করেন আবার বন্ধ রাখেন। এভাবে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে নেওয়ার পরও ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে মাত্র তিনতলার ছাদ পর্যন্ত কাজ করেই দীর্ঘ ৬ মাস যাবত কাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
সরেজমিনে ঈশ্বরদীর জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রটি ঘুরে দেখা গেছে, পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নিচে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। নির্মাণাধীন নতুন ভবনের সামনে রড, ইট-বালি পড়ে সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ সময় কাজ বন্ধ থাকায় ভবনের বিভিন্ন অংশ ছ্যাওলাতে ভরে গেছে। দেখে যেন মনে হচ্ছে কোন পরিত্যক্ত ভবন।
এদিকে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ে প্রভাব বিস্তার করে মেসার্স বার্ড কনস্ট্রাকশন একাই দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ভবন নির্মাণের অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু একটি ভবনের কাজও শেষ করেনি মেসার্স বার্ডস কনস্ট্রাকশন। মালামালসহ অন্য জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বারবার কাজ বন্ধ রেখে সময় বাড়িয়েছে।
ভবনটির নির্মাণকাজে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের মধ্যেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তবে এর সত্যতা যাচাইয়ে নির্মাণাধীন ভবনের সরকারি দরপত্র চেয়ে ঠিকাদারসহ প্রকৌশলীর দপ্তরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তা দিতে রাজি হননি কেউই।
ঈশ্বরদীর জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের কর্মরত কর্মচারীরা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের উপর। মোঃ ফরহাদ হোসেন নামে এক কর্মচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমার এখানে জয়েন করা তিন বছর হয়েছে। তখন থেকে দেখছি ভবনটির কাজ চলছে। আমরা পুরাতন ভবনে খুব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। বর্তমানে কেন কাজ বন্ধ রয়েছে তা সঠিক জানি না তবে শুনেছি ঠিকাদারের গাফিলতির কারণে ভবনের নির্মাণ কাজ ঝুলে আছে।'
কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের দৈনিক হাজিরার অফিস সহকারী মোঃ আজহার আলী বলেন, '২০২২ সালে কাজ শুরু করে কতবার যে কাজ বন্ধ রেখেছে তার কোন হিসাব নেই। এই ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখায় ভবনের ভিতর মাদকসেবীদের আড্ডা হয়। আর আমরা পুরাতন ভবনে খুব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি। আজ ৩ বছর ধরে দেখছি একটু করে কাজ চলে আবার বন্ধ হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক গাফিলতির কারণে এ কাজ এখনও ঝুলে আছে।'
ঈশ্বরদী জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ আদনান ইসলাম বলেন, 'তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ ভবনের কাজ চলছে যেটার নির্মাণকালীন সময় ছিল এক বছর। বর্তমানে ভবনের কাজ বন্ধ ফলে ভবনের বিভিন্ন অংশে ছ্যাওলা পড়ে ভবনের গুণগত মান নষ্টের পথে। রাত হলে নেশাখোরদের আড্ডা হয় যার কারণে আমাদের অফিসের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।'
ভবনটির নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকার কারণ জানতে বার্ড কনস্ট্রাকশনের স্বত্তাধিকারী আবুল কাসেম সীমান্তের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ক্ষিপ্ততার সুরে বলেন, 'ঈশ্বরদীর জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের এ কাজটি নিয়ে বড়ই পাপ করেছি, আর এখন সেই পাপের মাশুল দিচ্ছি। আমাদের কোন ফান্ড দিচ্ছে না যার কারণে রাগ করে কাজ বন্ধ রেখেছি। সরকার ফান্ড না দিলে কি বাড়ির জমি বিক্রি করে এনে কাজ করে দিব নাকি? তবে চেষ্টা করবো ফান্ড পেলে যত দ্রুত সম্ভব কাজটি শুরু করার।'
ঈশ্বরদী জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক ডা. মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, 'এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় নতুন ভবনের বরাদ্দ পেয়েছি। তবে ভবনটির কাজ এতটাই ধীরগতিতে হচ্ছে যার কারণে তিন বছরেও নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে কাজ বন্ধ রয়েছে এবং দীর্ঘ তিন বছর ধরে এ কাজ ঝুলে আছে। জানি না ভবনের নির্মাণ কাজ কেন বন্ধ রয়েছে। আমরা পুরাতন ভবনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। আমরা চাই নতুন ভবনের কাজটি দ্রুত শেষ হোক।'
তবে এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণীসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) পরিচালক ডা. জসিমউদদীন বলেন, 'ভবনটির নির্মাণকাজের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন না হওয়ার কারণে এমন সমস্যা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও খুব বিব্রত। তবে চেষ্টা করছি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে খুব শিগগিরই কাজ শুরু করানোর।'
এসআর