এইমাত্র
  • আবারও বিশ্বজয় করেছেন হাফেজ আনাস
  • আসিফ মাহমুদ গণঅধিকারে যোগ দিতে পারেন
  • চিকিৎসা নিতে পারছেন খালেদা জিয়া, গুজব ছড়াবেন না: ডা. জাহিদ হোসেন
  • পরিচয়পত্র যাচাই করে কাজের লোক ঠিক করুন: উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী
  • নোবেল শান্তি পুরস্কারের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না মাচাদো
  • পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলিতে ইমরান খান-পিটিআইকে নিষিদ্ধের দাবিতে প্রস্তাব পাস
  • ক্যানসার সৃষ্টিকারী জিনবাহী দাতার শুক্রাণুতে ২০০ শিশুর জন্ম
  • অল্প সময়ে তোমরা জাতিকে যা দিয়েছ, তা জাতি কখনো ভুলবে না
  • ইরান সফরের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন লেবাননের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
  • পুলিশি নিরাপত্তায় সচিবালয় ছাড়লেন অর্থ উপদেষ্টা
  • আজ বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    মেগা প্রকল্পে নিষিদ্ধ চুনাপাথর ব্যবহার, নিরাপত্তা সংকটে রেল

    গাজী গোফরান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (চট্টগ্রাম) প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম
    গাজী গোফরান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (চট্টগ্রাম) প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম

    মেগা প্রকল্পে নিষিদ্ধ চুনাপাথর ব্যবহার, নিরাপত্তা সংকটে রেল

    গাজী গোফরান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (চট্টগ্রাম) প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৪০ পিএম

    বাংলাদেশের রেলওয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের নামে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোতে ব্যালাস্ট হিসেবে চুনাপাথর ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে, যা রেলপথ প্রকৌশল মানদণ্ডে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল রেল নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ভিত্তি স্তরেই এমন প্রযুক্তিগত বিপর্যয় ও দুর্নীতির প্রমাণ উঠে আসায় প্রশ্নের মুখে ভবিষ্যত রেল নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্য।

    রেল প্রকৌশলে ব্যালাস্ট তথা রেললাইনের নিচে বিছানো পাথর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই ব্যালাস্ট যান্ত্রিকভাবে শক্ত, পানি শোষণহীন ও ঘর্ষণ প্রতিরোধী হতে হয়। সাধারণত গ্রানাইট, বেসাল্ট বা ডায়াবেস জাতীয় আগ্নেয় শক্ত পাথর ব্যালাস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যালাস্ট মানে পানি শোষণ ক্ষমতা ১% এর নিচে।

    কিন্তু বাংলাদেশে রেলপথে ব্যবহৃত হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল, রাসায়নিকভাবে সক্রিয় এবং পানি শোষণক্ষম চুনাপাথর, যা রেল প্রকৌশলে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। পানি শোষণকারী এই লাইমস্টোন ট্রেন চলাচলের কম্পনে দ্রুত গুঁড়ো হয়ে কাদার মতো রূপ নেয়, ব্লক করে দেয় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ফলে ট্র্যাক বসে যেতে শুরু করে, স্লিপার ডুবে যায় এবং রেল নিরাপত্তা ভয়াবহভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ে।

    আন্তর্জাতিক গবেষণা এই অভিযোগ আরও স্পষ্ট করে। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইউনলং গুও Construction and Building Materials জার্নালের ২০২২ সালের গবেষণায় চুনাপাথরকে ব্যালাস্ট হিসেবে প্রায় অযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। গবেষণা অনুযায়ী চুনাপাথরের উপযোগিতা ০% এর কাছাকাছি, বিপরীতে গ্রানাইট ও বেসাল্টের উপযোগিতা ৭০ থেকে ১০০%। কম্প্রেশনাল ওয়েভ ভেলোসিটি টেস্টে গ্রানাইট ও বেসাল্ট যেখানে ৪–৫ কিমি/সেকেন্ড, সেখানে চুনাপাথর মাত্র ২–৩ কিমি/সেকেন্ড, যা ব্যালাস্ট পরীক্ষার মানদণ্ডে বাতিলযোগ্য।

    তবু কেন বাংলাদেশে এই চুনাপাথর সংগ্রহ করা হলো? তদন্তে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিনা সাকর বন্দর থেকে এমভি আব্দুল্লাহ নামের একটি জাহাজে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য এক লাখ টন চুনাপাথর আমদানি করা হয়। এই পাথর ব্যবহার করা হয়েছে দোহাজারী–কক্সবাজার রেল প্রকল্পে। চট্টগ্রাম বন্দরের রেকর্ডে পাথরের ধরন ‘লাইমস্টোন’ হিসেবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

    তদন্তে উঠে এসেছে নাম, নথি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক এবং বর্তমানে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন এবং রেলওয়ের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) আবু জাফর মিয়াকে এই সিদ্ধান্তের মূল ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের সরাসরি আদেশে এই অনিয়ম বাস্তবায়ন হয়েছে বলে অভিযোগ।

    সরকারি নথি অনুসারে কক্সবাজার রেললাইন (১০২ কিমি), পদ্মা সেতু রেল সংযোগ (১৭২ কিমি) এবং আখাউড়া–লাকসাম দ্বৈত লাইন নির্মাণ প্রকল্পে মোট ব্যবহৃত হয়েছে ১১ লাখ কিউবিক মিটার পাথর। এই পাথরের সরকারি মূল্য ৭৬৭ কোটি টাকা হলেও অস্বাভাবিক মূল্যায়ন ও প্রক্রিয়ায় তা ১৪০০ কোটিরও বেশি বিল করা হয়েছে।

    আরও বিস্ময়কর তথ্য হলো, যে পাথর বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে, সেটি দেশেই উৎপাদিত হয় এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। দিনাজপুরের মধ্যপাড়া পাথর খনিতে রয়েছে ১২ লাখ ২০ হাজার টন বোল্ডার ও ব্লাস্ট পাথর, যার মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। রেলওয়ে ও পানি উন্নয়ন বোর্ড ক্রয় কমিয়ে দেওয়ায় এই পাথর এখন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।

    অথচ এই খনি থেকেই আগে রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয় ব্যালাস্ট সংগ্রহ করা হতো। খনি এখন কার্যত সংকটাপন্ন অবস্থায়, উৎপাদন চললেও ক্রেতা নেই, এটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এক নির্মম উদাহরণ।

    অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সরকারি প্রভাব, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। শুধু রেল খাতেই তারা গত এক যুগে ৪০ হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।

    চকরিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া এবং কক্সবাজার স্টেশন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষায় দেখা যায়, বেশিরভাগ পাথরের রঙ সাদা, ধূসর ও বাদামি, যা লাইমস্টোনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

    পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, চুনাপাথরের গুঁড়ো বাতাসে মিশে গেলে সৃষ্টি হয় ধুলো দূষণ এবং শ্বাসযন্ত্র রোগের ঝুঁকি। বর্ষায় এই গুঁড়ো পানিতে মিশে রাসায়নিক দূষণ সৃষ্টি করে কৃষি জমি, নদী এবং পানির উৎসকে বিষাক্ত করে তোলে।

    রেলপথ এক্টিভিস্ট নাজিব আহমদ সময়ের কন্ঠস্বর-কে বলেন, কক্সবাজার রেল চালুর দিনে ট্রেনে ভ্রমণের সময় এক পর্যায়ে জানালা বন্ধ করতে বাধ্য হতে হয়, চুনাপাথরের ধুলো এতটাই ছড়াচ্ছিল যে চোখ খোলা রাখা কঠিন হয়ে যায়।

    অভিযোগের বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. সুবক্তগীন দাবি করছেন, সব পাথর বুয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, কোন অনিয়ম হয়নি। কিন্তু বুয়েটের সেই পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি, যা রহস্যকে আরও ঘনীভূত করছে।

    বিষয়টি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নজরে আনা হলে তিনি জানান, ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “রেল প্রথম থেকেই দুর্নীতিতে ভরা, আমরা সিস্টেম পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি।”

    বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্পগুলোতে বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে বুয়েট, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আন্তর্জাতিক রেল প্রযুক্তি সংস্থার সম্পৃক্ততায় পূর্ণাঙ্গ ফরেনসিক অডিট জরুরি। তাদের দাবি, যদি এই কেলেঙ্কারি তদন্ত ও বিচার ছাড়া চাপা পড়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ রেলভ্রমণ প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের এক নতুন অধ্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।

    এসএম

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    Loading…