দক্ষিণ চট্টগ্রামের ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র সাতকানিয়ার কেরানীহাটে অবৈধ দোকান ও স্থাপনা সরাতে মাইকিং করে দেওয়া এক সপ্তাহের আল্টিমেটাম দুই মাস পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি। গত ১০ অক্টোবর সন্ধ্যায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে নতুন করে গড়ে ওঠা সব অবৈধ দোকান ও স্থাপনা সাত দিনের মধ্যে নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত কোনো উচ্ছেদ অভিযান হয়নি। ফলে ফুটপাত ও সওজের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা দোকানপাট ও যানবাহনের কারণে কেরানীহাটে যানজট আগের চেহারাতেই ফিরে এসেছে।
ওইদিনের মাইকিংয়ের পর কেরানীহাট এলাকায় কিছুদিন উচ্ছেদ আতঙ্ক দেখা দিলেও তা দ্রুত কেটে যায়। বর্তমানে কেরানীহাট এলাকায় টিনের চালের দোকান, চায়ের স্টল, ভ্রাম্যমাণ দোকান এবং সারিবদ্ধভাবে রাখা ট্রাক–ডাম্পার আগের মতোই অবস্থান করছে। এতে মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সংকুচিত হয়ে পড়েছে, ফলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যানজট নিত্যদিনের চিত্র।
মাইকিং ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল উচ্ছেদের পর নতুন করে স্থাপিত সব অবৈধ দোকান ও স্থাপনা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরিয়ে না নিলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই দিন রাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে কেরানীহাটের যানজটের জন্য অবৈধ দখল ও পরিবহন মালিকদের দায় উল্লেখ করেন।
তবে ঘোষণার দুই মাস পার হলেও বাস্তবে কোনো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়নি। এতে স্থানীয়দের মধ্যে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কেরানীহাট মোড় থেকে কাঁচাবাজার পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দুই পাশের ফুটপাত পুরোপুরি দখল হয়ে আছে। এছাড়া কেরানীহাট-বান্দরবান জাতীয় মহাসড়কের কোথাও চায়ের দোকান, কোথাও খাবারের স্টল, আবার কোথাও সওজের জায়গায় রাখা হয়েছে ট্রাক ও ডাম্পার। এতে মূল সড়ক কার্যত এক লেনে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, উচ্ছেদের সময় আমরা স্বস্তি পাই। কিন্তু সেটা টেকে না। এখন তো ঘোষণার দুই মাস পেরিয়ে গেল কিছুই হয়নি।
কেরানীহাটের পুনর্দখলের পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র সক্রিয় এমন অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী। একাধিক দোকানদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সওজের জায়গায় দোকান বসাতে মাসিক ‘ভাড়া’ দিতে হয়।
একটি সূত্র জানায়, এই দখলকে কেন্দ্র করে প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা হাতবদল হয়। ফলে প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার দখল শুরু হয় এবং কিছুদিন পর প্রশাসনিক তৎপরতা থেমে যায়।
একজন সমাজকর্মী বলেন, কেরানীহাটে দখল এখন শুধু অবৈধ স্থাপনার বিষয় নয়, এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক চক্র। এই চক্র ভাঙা না গেলে উচ্ছেদ কখনোই স্থায়ী হবে না।
অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া উচ্ছেদ মানেই তাদের পথে বসা। চায়ের দোকানি তুষার বলেন, আমরা জানি জায়গাটা সরকারি। কিন্তু বসতে না দিলে পরিবার চলবে কীভাবে? প্রশাসন শুধু উচ্ছেদ বলে, বিকল্প কোনো ব্যবস্থা দেয় না।
উচ্ছেদ অভিযান থমকে যাওয়ার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান বলেন, কেরানীহাটে উচ্ছেদ অভিযান নিয়ে উপজেলা প্রশাসন পরিকল্পিতভাবেই এগোচ্ছে, যাতে আগের মতো উচ্ছেদের পর আবারও দখল না হয়।
তিনি বলেন, কেরানীহাট একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে হাজারো মানুষের জীবিকা যেমন জড়িত, তেমনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রধান সড়ক ব্যবস্থাও এই বাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জনদুর্ভোগ ও ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা সবকিছু বিবেচনা করেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ইউএনও জানান, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে উচ্ছেদের পর পুনরায় কেউ দখল নিতে না পারে। প্রয়োজনে নজরদারি ও নিয়মিত মনিটরিং বাড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, উচ্ছেদ অভিযান হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যেকোনো দিন অভিযান পরিচালনা করা হতে পারে। তবে লক্ষ্য শুধু একদিনের উচ্ছেদ নয়, কেরানীহাটকে স্থায়ীভাবে যানজটমুক্ত রাখা।
এসআর