চলছে ডিসেম্বর মাস। আর ডিসেম্বর মাস মানেই বাচ্চাদের জন্য আনন্দ আর ছুটির আমেজ, কারণ এই সময়ে বার্ষিক পরীক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়। তাই দরিয়াপাড়ে বেড়াতে আসা লোকজনের সংখ্যা নিত্যদিন বাড়ছে। ভ্রমণপিপাসু পরিবারগুলোর পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে বেলাভূমি। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত নানা বয়সের পর্যটকে লোকারণ্য হয়ে আছে সৈকততীর ও পর্যটন স্পটগুলো।
এবছর থার্টিফাস্ট নাইটের পরের সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ে পাঁচ-দশ লাখের বেশি পর্যটক উপস্থিতির আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসময় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্যের আশাও করছেন তারা।
হিমশীতল কুয়াশা মাখা হাওয়ায় সূর্যাস্ত দেখতে লোকারণ্য সৈকতের বেলাভূমি। ভিড় রয়েছে হোটেল-মোটেল জোনের অলিগলি ও রাস্তায়। পর্যটকবাহী ও সাধারণ পরিবহন এবং ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশায় বাইবাস সড়ক, কলাতলী ডলফিন মোড়, হোটেল-মোটেল জোন, লাবণী-শৈবাল সড়ক সবখানেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে নাকাল হচ্ছেন পর্যটকরা। বড় বাসগুলো টার্মিনাল এলাকায় থাকলেও মাঝারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি পর্যটন এলাকা ও শহরে ঢোকায় এ যানজট বলে অভিমত স্থানীয়দের।

পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ। মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশও। মাঠে টহল দিচ্ছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ ভ্রাম্যমাণ আদালত। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে পর্যটন স্পটগুলো।
পর্যটন ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, পরীক্ষার পরের সময়ের পরিকল্পনায় ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আগমন ঘটছে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। সপ্তাহ-পক্ষকাল আগে থেকেই আগাম বুকিং হয়ে আছে পর্যটনকেন্দ্রিক সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সতর্ক অবস্থায় দায়িত্বপালন করছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশ।
চট্টগ্রামের শুল্ক বহরের এশিয়ান হাউজিং থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসা মাসুদ হোসাইন বলেন, দু’মাস পর জাতীয় নির্বাচন। সামনের পরিস্থিতি কী হয় অনুমান করা মুশকিল। তাই সবার সিদ্ধান্তে শুক্রবার পরিবারের সবাইকে নিয়ে কক্সবাজারের ওশান প্যারাডাইস হোটেলে উঠেছি। তিন রাত থাকার পর সোমবার সকালে ফিরে যাবো। এই তিনদিন পুরো হোটেল পর্যটকে ভর্তি বলে মনে হয়েছে।
এদিকে হোটেল মোহাম্মদীয়া গেস্ট হাউসের ব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান বলেন, মৌসুমে কমবেশি পর্যটক নিত্যদিন কক্সবাজারে অবস্থান করেন। কিন্তু বিজয় দিবসের ছুটি ও পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসছেন ভ্রমণপ্রেমীরা।
কক্সবাজার টুরিস্ট ক্লাবের সভাপতি মো. রেজাউল করিম বলেন, শুধু কক্সবাজার নয়, ইনানী-হিমছড়ি, সেন্টমার্টিনসহ সব পর্যটন স্পটে পর্যটকের উপস্থিতি বেড়েছে। আগামী ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সেন্টমার্টিন নৌরুটে চলাচল করা সাতটি পর্যটকবাহী জাহাজের টিকিট আগাম বুকিং হয়ে আছে।
কলাতলীর সি নাইট গেস্ট হাউজের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, এখনো অতীতের মতো ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত লোকজন আসেনি। তবে মন্দা সময়ের চেয়ে ভালোই পর্যটক উপস্থিতি রয়েছে। এটা চলমান থাকলে অতীতের লোকসান পোষানো সম্ভব।
সৈকতের সি সেইফ লাইফ গার্ডের সিনিয়র কর্মী মোহাম্মদ ওসমান বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই উল্লেখ করার মতো পর্যটক সকাল থেকেই ঢেউয়ের সঙ্গে খেলছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলমান থাকে এ আনন্দ। হঠাৎ বিশাল পানির রথে আত্মহারা হয়ে অনেকে বিপৎসীমার বাইরেও চলে যান। তাদের কিনারায় আনতে কাজ করার পাশাপাশি নিরাপদ থাকতে বারবার সতর্ক করেন আমাদের (লাইফগার্ড) কর্মীরা।
কক্সবাজার হোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, পর্যটন জোনে ৫ শতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় লাখ পর্যটক থাকার ব্যবস্থা হয়। বিজয় দিবসের ছুটির পর থেকে কক্সবাজারে লোকসমাগম বেড়েছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনেক হোটেল-মোটেলে আগাম বুকিং আছে। বছরের শেষ দিকে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের সঙ্গে সাপ্তাহিক মিলিয়ে টানা ছুটি থাকছে। এতে সরকারি কর্মজীবীরাও বেড়াতে আসবেন। এসময় পর্যটকের চাপ আরও বাড়বে। বছরের শেষ ও আগামী বছরের শুরুতে কক্সবাজারে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক সমাগম ঘটতে পারে। এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হতে পারে।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়ন প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, মৌসুমের শুরু থেকেই পর্যটক হয়রানি রোধে বাড়তি তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। অভিযোগ পেলেই গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য নির্ধারিত হেল্পলাইন-০১৩২০১৬০০০০ নম্বরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান বলেন, সৈকতের সুগন্ধা-লাবনী ও কলাতলী পয়েন্টে পর্যটক সমাগম একটু বেশি। তবে সব পয়েন্টে পর্যটকরা নামছে। তাই প্রতিটি পয়েন্টে তথ্যকেন্দ্র সচল রয়েছে। কোথাও পর্যটক হয়রানির অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে মাঠে রয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এএনএম সাজেদুর রহমান বলেন, পর্যটকদের লক্ষ্মীজ্ঞান করে তাদের নিরাপত্তায় সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ। অনাকাঙ্ক্ষিত যেকোনো ঘটনা রোধে, পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে এবং পর্যটক বেশেও পুলিশের নারী সদস্যরা সৈকতে ঘুরছেন। টহলে রয়েছে এলিট ফোর্স র্যাবও।