এইমাত্র
  • ৬ দিনে এলো ৬৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স
  • নতুন বাবরি মসজিদের জন্য একজন একাই দিচ্ছেন ৮০ কোটি টাকা
  • ৪ নারী পাচ্ছেন বেগম রোকেয়া পদক
  • নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনে কমিশন সম্পূর্ণ প্রস্তুত, প্রধান উপদেষ্টাকে জানালেন সিইসি
  • ইরানে ম্যারাথনে হিজাব লঙ্ঘনের অভিযোগে আয়োজক গ্রেফতার
  • সৌদিতে এক সপ্তাহে ১৯ হাজারের বেশি প্রবাসী গ্রেপ্তার
  • ইসরায়েলের রাজনীতি থেকে কী সরে দাঁড়াচ্ছেন নেতানিয়াহু
  • পেঁয়াজ আমদানি শুরু, এক লাফে প্রতিকেজিতে দাম কমল ৩০ টাকা
  • দেশে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন খালেদা জিয়া: মেডিকেল বোর্ড
  • খালেদা জিয়ার সিটি স্ক্যান সম্পন্ন, রিপোর্ট নরমাল: মেডিকেল বোর্ড
  • আজ সোমবার, ২৪ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    উন্নয়নের নেশায় এলজিইডি ছিনিয়ে নিচ্ছে সাতকানিয়ার সবুজ

    মো. জাহেদুল ইসলাম, সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫১ পিএম
    মো. জাহেদুল ইসলাম, সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫১ পিএম

    উন্নয়নের নেশায় এলজিইডি ছিনিয়ে নিচ্ছে সাতকানিয়ার সবুজ

    মো. জাহেদুল ইসলাম, সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫১ পিএম

    চট্টগ্রামের দক্ষিণের জনবহুল উপজেলা সাতকানিয়া। চারপাশে পাহাড়, নদী আর শত শত গাছের ছায়ায় ঘেরা এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবেই পরিচিত। এই উপজেলার প্রাণকেন্দ্র সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে রাস্তার মাথা পর্যন্ত একটি চার কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক—যা বরাবরই ছিল শান্ত, ছায়াঘেরা, প্রশান্তিময় এক চলাচলের পথ। কিন্তু এখন সেই সড়কজুড়ে ঝুলছে এক ভয়ংকর শিরোনাম—“গাছ কাটবে এলজিইডি”।

    ‘চট্টগ্রাম বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ (সিডিডব্লিউএসপি)’ নামে একটি প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এই সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে, উপজেলা সদরের সংযোগ উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবে এটি কোনো প্রধান সড়ক নয়।

    তারপরও, ৮ কোটি ৪৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন এলজিইডি প্রস্তুত ৭৮২টি ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ কেটে ফেলতে। এবং এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী সবুজ কুমার দে—যার বক্তব্য অনুযায়ী, “উন্নয়নের স্বার্থে কিছু গাছ কাটা অনিবার্য।” কিন্তু স্থানীয়দের প্রশ্ন—উন্নয়ন নাকি ধ্বংস?

    ২০২৪–২৫ অর্থবছরের এই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ হাতে নেয় এলজিইডি। কিন্তু প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সংযোগ সড়কগুলোর উন্নয়ন। সাতকানিয়ার যে সড়কটিতে এখন গাছ কাটার প্রস্তুতি চলছে—তা উপজেলা সদরের প্রধান সংযোগ নয়।

    বাসিন্দাদের ভাষায়, এ পথ দিয়ে সরকারি দপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ও কিছু শিক্ষার্থী যাতায়াত করেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ বেশি ব্যবহার করে রাস্তার মাথা–বাঁশখালী সড়ক।

    সাতকানিয়া পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রবিউল আলম বলেন, এই সড়কটি মূল যাতায়াতপথ নয়। উপজেলার অধিকাংশ মানুষ অন্য সড়ক ব্যবহার করে। অথচ এখানে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে শুধু কিছু গাছ কেটে প্রশস্ত করার জন্য। এটি অযৌক্তিক ও অপচয়মূলক উন্নয়ন।

    এলজিইডির প্রকল্প নথি অনুযায়ী, সড়কটির কাজ পায় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার মেসার্স বসুন্ধরা নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ঠিকাদার কাজ শুরুর অনুমতি পায় ২০২৫ সালের জুনে, এবং প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা নির্ধারিত হয় ২০২৬ সালের ডিসেম্বর। কিন্তু প্রকল্প শুরুর পর তিন মাসেও মাঠপর্যায়ে কোনো বড় কাজ হয়নি—শুরু হয়েছে শুধু “গাছ কাটার প্রস্তুতি”।

    উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে রাস্তার মাথা পর্যন্ত হেঁটে গেলে চোখে পড়ে সবুজের মেলা। ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত আম, জাম, ছাতিয়ান, বকুল, নিম, সেগুন, মহুয়া, কর্পূর, কাঁঠাল, মেহগনি ও ঔষধি গাছ। গরমের দিনে এই রাস্তা দিয়ে চললে সূর্যের তীব্র রোদ তেমন স্পর্শ করে না। পুরো সড়ক যেন প্রকৃতির ছায়াঘেরা এক টানেল। কিন্তু এখন সেই ছায়াঘেরা রাস্তার পাশে লাল দাগ টানা হয়েছে প্রতিটি গাছে। লাল রঙের দাগ মানেই মৃত্যুবার্তা—যতক্ষণে ঠিকাদারি করাত চলবে, ততক্ষণে হারিয়ে যাবে এই সবুজ আচ্ছাদন।

    দক্ষিণ ঢেমশার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, এই গাছগুলো শুধু সৌন্দর্য বাড়ায়নি, বাতাস ঠান্ডা রাখত। রোদে মানুষ এই গাছের নিচে বিশ্রাম নিত। এখন সেগুলো কেটে ফেলা হবে—তাহলে আমাদের শ্বাস নেওয়ার বাতাসও গরম হয়ে যাবে।

    তিনি যোগ করেন, উন্নয়ন চাই, কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। নতুন গাছ লাগালেও সেই গাছ বড় হতে অন্তত দশ বছর লাগবে। এই দশ বছর আমরা কিসে বাঁচব?

    সাতকানিয়ার স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী মলিন বড়ুয়া বলেন, উন্নয়ন হোক, কিন্তু সেটা যেন প্রকৃতি হত্যার মাশুলে না হয়। প্রতিটি গাছ একেকটি প্রাণ। সবুজ কুমার দে সাহেব বলছেন, এক গাছের বদলে দুই গাছ লাগাবেন। কিন্তু সেটি কোথায় লাগাবেন? কে দেখবে? এই গাছগুলো ছিল জীবন্ত ছায়া, পাখির আশ্রয়। সেগুলো কেটে দিলে এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে।

    চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের মাদার্শা রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন বলেন, উপজেলা চত্বর থেকে রাস্তার মাথা পর্যন্ত ৭৮২টি গাছ পরিমাপ করা হয়েছে। এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ লাখ ১৮ হাজার ৯৪২ টাকা। এই মূল্যের সঙ্গে ভ্যাট ও আয়কর যোগ হবে। এরপর এলজিইডি কর্তৃপক্ষ দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে গাছগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবে। অর্থাৎ, সবুজ বিক্রির প্রশাসনিক অনুমতি এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা।

    এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী সবুজ কুমার দে বলেন, সড়কের প্রস্থ ১২ ফুট থেকে ১৮ ফুট করা হচ্ছে। ফলে কিছু গাছ কাটা লাগবে। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই—আমরা প্রতিটি কাটা গাছের বদলে দুটি করে নতুন গাছ লাগাব।

    তার এই বক্তব্য নিয়ে স্থানীয়রা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তাদের মতে, যে সংস্থা গাছ লাগানোর কথা বলে সেটিই এখন করাত চালাচ্ছে—এ যেন নিজেরই সন্তান হত্যা। তারা বলছেন, যে প্রকৌশলীর নামে সবুজ, সে-ই আজ সবুজ হত্যা করছে।

    পরিবেশবিদরা বলছেন, এলজিইডির কথিত ‘দুই গাছ লাগানোর’ পরিকল্পনা মূলত লিখিত কাগজেই থেকে যাবে। কারণ সড়ক উন্নয়নের পর একই স্থানে পুনরায় গাছ লাগানোর জায়গাই থাকবে না। তাদের মতে, এলজিইডি সব সময় উন্নয়নের নামে স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের পথ বেছে নেয়। সবুজ কুমার দে–র নেতৃত্বে এই প্রকল্প তারই ধারাবাহিকতা।

    পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাতকানিয়ার এই সড়ক থেকে ৭৮২টি গাছ কেটে ফেলা হলে তাপমাত্রা গড়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়বে। এছাড়া পাখি, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, মৌমাছির মতো ক্ষুদ্রপ্রাণীরা আশ্রয় হারাবে। তাদের মতে, একটি এলাকায় ৫০০টির বেশি গাছ কাটলে সেটি পরিবেশ বিপর্যয়ের শামিল। এখানে প্রায় ৮০০ গাছ কাটা হবে—এটি চরম অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।

    উপজেলার তরুণ সংগঠক মো. সায়েদ হোসেন মানিক বলেন, এই গাছগুলো আমাদের শৈশবের অংশ। প্রতিটি গাছে পাখির বাসা, শিশুরা খেলে। এখন সেগুলো কেটে দিলে সাতকানিয়া আর সাতকানিয়া থাকবে না।

    অন্যদিকে কৃষক আবদুল হালিম বলেন, আমাদের জমির পাশ দিয়ে গাছগুলো ছিল। গরমে সেই ছায়া ফসল বাঁচাত। এখন সূর্যের তাপে জমিও পুড়ে যাবে।

    বিশেষজ্ঞদের মতে, সাতকানিয়ার মতো গ্রামীণ এলাকায় বড় আকারের বৃক্ষনিধন হলে তা শুধু স্থানীয় নয়, বরং আঞ্চলিক পরিবেশেও প্রভাব ফেলে। বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়বে, সড়কের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, মানুষের হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়বে।

    চিকিৎসকদের মতে, যখন গাছ কেটে সড়ক খোলা হয়, তখন সূর্যের তাপমাত্রা সরাসরি মানুষের শরীরে পড়ে। এটি স্থানীয়ভাবে ‘হিট আইল্যান্ড এফেক্ট’ তৈরি করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর।

    এনআই

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    চলতি সপ্তাহে সর্বাধিক পঠিত

    সর্বশেষ প্রকাশিত

    Loading…