ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বহাল তবিয়তে রয়েছেন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ফলদা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. আবু সাঈদ স্বপন। অভিযোগের সত্যতা মিললেও তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় জড়িয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির স্থানীয় দুই নেতা প্যানেল চেয়ারম্যানকে রক্ষা করতে তদবির চালাচ্ছেন। ফলে রাজনৈতিক প্রভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের প্রক্রিয়া।
জানা গেছে, গত ২৭ আগস্ট প্যানেল চেয়ারম্যান আবু সাঈদ স্বপনের বিরুদ্ধে ৭ জন ইউপি সদস্যের স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়া হয়। এতে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, সরকারি বরাদ্দে অনিয়ম, ভিজিডি–ভিজিএফ কার্ড বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁকে অপসারণের দাবি জানানো হয়।
এ নিয়ে সময়ের কণ্ঠস্বরে সংবাদ প্রকাশিত হলে তৎকালীন ইউএনও মো. আবু আবদুল্লাহ খান ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে বদলিজনিত কারণে বিষয়টি আর অগ্রসর হয়নি। প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার অনুরোধে অভিযোগের তদন্ত কার্যক্রম তখন স্থগিত রাখা হয়।
এরপর এক মাস না যেতেই প্যানেল চেয়ারম্যান স্বপনের বিরুদ্ধে নতুন করে ওঠে সরকারি ভিডব্লিউবি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট) কর্মসূচির প্রায় পৌনে ২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। অভিযোগ অনুযায়ী, সুবিধাভোগীদের সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংকে জমা না রেখে তিন মাস ধরে নিজের কাছে রেখেছিলেন তিনি।
এ বিষয়ে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘ভূঞাপুরে ভাতাভোগীদের সঞ্চয়ের টাকা প্যানেল চেয়ারম্যানের পকেটে’ শিরোনামে সময়ের কণ্ঠস্বরে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। পরদিনই চেয়ারম্যানের নির্দেশে গ্রাম পুলিশরা ভাতাভোগীদের টাকা ফেরত দেন। এর পর ৩০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো. রাজিব হোসেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিমা আক্তারকে প্রধান করে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তবে এক মাস পেরিয়ে গেলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আনা হয়নি। প্রশাসনের ভেতরেই বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিমা আক্তার সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'আমি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।' তবে বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুব হাসান কোনো প্রতিবেদন হাতে পাননি জানিয়ে বলেন, 'আমি যোগদানের আগেই একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল।'
অন্যদিকে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মো. রাজিব হোসেন বলেন, 'আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। এর দুইদিন পর নতুন ইউএনও যোগ দেন, তাই পরবর্তী বিষয়ে আমি অবগত নই।'
প্রশাসনিক সূত্র জানায়, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে নতুন ইউএনও যোগদানের পর আগের ইউপি সদস্যদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আবারও তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাজিব হোসেন, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিমা আক্তার ও সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমুল হাসানকে সদস্য রাখা হয়।
তদন্ত কমিটির সূত্রে জানা গেছে, প্যানেল চেয়ারম্যান স্বপনের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে প্রতিবেদনটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হয়নি। বরং তদন্ত চলাকালীন সময়েই ইউপি সদস্যদের দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের চিঠিতে স্বাক্ষর করানোর অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র জানিয়েছে, প্যানেল চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই এবং ফলদা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শিমু তালুকদার তাঁকে বহাল রাখতে তদবির চালাচ্ছেন। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করছেন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হান্নান।
একাধিক সূত্র জানায়, তদন্ত চলাকালীন সময়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে তদন্ত কমিটির একাধিক বৈঠক হয়, যেখানে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পান এবং নিজের অবস্থান সমর্থনে কিছু কাগজপত্রও দাখিল করেন। তবে অভিযোগ উঠেছে, যখন তিনি বুঝতে পারেন তদন্ত প্রতিবেদন তার বিপক্ষে যেতে পারে, তখন রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে তদন্ত বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন।
ইউনিয়নের কয়েকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি হান্নান ও সাধারণ সম্পাদক শিমু তালুকদার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ইউপি সদস্যদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। সাতজনের মধ্যে ৪ জন সদস্যকে দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের চিঠিতেও স্বাক্ষর করানো হয়েছে।'
যদিও অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে বিএনপি নেতা হান্নান ও শিমু তালুকদার সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা। এটি ইউনিয়ন পরিষদের বিষয়, আমরা কোনোভাবেই জড়িত নই।'
জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও তদন্ত কমিটির সদস্য মো. রাজিব হোসেন সময়ের কণ্ঠস্বরকে জানান, আগের তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানেন না। তবে প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নতুন করে আরও কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার সদস্য হিসেবেও তিনি আছেন। প্রতিবেদন প্রস্তুত রয়েছে এবং দুই-এক দিনের মধ্যেই তা জমা দেওয়া হবে।
সম্প্রতি কয়েকজন ইউপি সদস্য অভিযোগ প্রত্যাহারের চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই, তবে আমাদের তদন্তে কেউ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।’
অপরদিকে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাহবুব হাসান সময়ের কণ্ঠস্বরকে জানান, ভাতাভোগীদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন তিনি পাননি এবং এই প্রতিবেদন তার দায়িত্ব গ্রহণের আগেই জমা দেওয়া হয়েছিল।
তিনি জানান, যোগদানের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে আরও কিছু অভিযোগের কাগজ আমাদের কাছে এসেছে। এজন্য আমরা একটি নতুন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি, যারা প্রকাশ্যে ও গোপনে তদন্ত করছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
অভিযোগ প্রত্যাহার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।’
এসকে/আরআই