দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন জয়শঙ্কর জমিদার বাড়ি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। উপজেলার আলোকঝাড়ি ইউনিয়নের জয়গঞ্জ গ্রামে, আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত এই শতবর্ষী জমিদার বাড়িটি একসময় ছিল এ অঞ্চলের সামাজিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে এখন এটি পরিণত হয়েছে ধ্বংসপ্রায় এক নীরব ঐতিহাসিক স্থাপনায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অযত্নে পড়ে থাকা জয়শঙ্কর রায় চৌধুরীর জমিদার বাড়িটির বড় একটি অংশ ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। ভবনের দেয়ালের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত। কোথাও ফাটল, কোথাও ইট-সুরকি বেরিয়ে এসেছে। বাড়িটির ভেতরের বহু মূল্যবান সামগ্রী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে, পাশাপাশি চুরি হয়ে গেছে অনেক ঐতিহাসিক উপকরণ।
স্থাপত্যগত দিক থেকে জমিদার বাড়িটি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একতলা এই ভবনে রয়েছে তিনটি প্রশস্ত বারান্দা, একটি বসার ঘর, একটি থাকার ঘর, সম্পদ সংরক্ষণের একটি কক্ষ এবং একটি মন্দির কক্ষ। তিনটি বারান্দায় রয়েছে মোট ৩০টি পিলার। পূর্ব দিকের প্রথম কক্ষটিতে ছিল নয়টি দরজা এবং সভা পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত কক্ষটিতে রয়েছে ১০টি দরজা, যা জমিদার আমলের স্থাপত্য ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে।
জমিদার বাড়ির পূর্ব দিকে কয়েক গজ দূরে রয়েছে একটি পুরোনো ইঁদারা বা কুয়া, যার পানি একসময় জমিদার বাড়ির নিত্যকার কাজে ব্যবহার হতো। বর্তমানে সেই কুয়াটি সম্পূর্ণ অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। চারপাশে ঘন ঝোপ-জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্থাপনাটি যেন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ লড়াই লড়ছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে জমিদার আমলের সেই ঐতিহাসিক বটগাছ অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে থাকায় জমিদার বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সেখানে ৫০টি পরিবারের জন্য একটি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মূল ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমনকি জমিদার বাড়ির প্রবেশপথে থাকা লোহার গেটটি বর্তমানে খানসামা থানার প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ঐতিহ্য সংরক্ষণে চরম উদাসীনতারই প্রতিফলন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
জমিদারি আমলে স্থাপিত জয়গঞ্জ বাজারটিও প্রায় ২০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আজ শুধু স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে জমিদার আমলের সেই বটগাছ ও জরাজীর্ণ ভবনটি।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের মতে, জয়শঙ্কর জমিদার বাড়িটি যথাযথভাবে সংস্কার করা হলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারত। এখনো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইতিহাসপ্রেমীরা এই জমিদার বাড়িটি দেখতে আসেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে সেই সম্ভাবনা আজ অনিশ্চিত।
এ বিষয়ে খানসামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ কামরুজ্জামান সরকার বলেন,জয়শঙ্কর জমিদার বাড়ির বিষয়টি আমাদের নজরে রয়েছে। এটি একটি পুরোনো স্থাপনা হওয়ায় সংরক্ষণ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্দেশনা প্রয়োজন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও নির্দেশনা পাওয়া গেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে প্রশাসনের এই বক্তব্যের বিপরীতে বাস্তবে এখন পর্যন্ত কোনো সংরক্ষণ কার্যক্রম বা প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ফলে স্থানীয়দের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই খানসামার একমাত্র ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে।
ইতিহাস হারালে শুধু একটি স্থাপনাই নয়, হারিয়ে যাবে একটি জনপদের পরিচয় এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
এসআর