গত-কয়েক বছর আগেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন হাফিজুল ইসলাম। নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল অভাব-অনটন। অথচ অল্প সময়ের ব্যবধানে এখন তিনি বিপুল সম্পদের মালিক।
স্থানীয়দের কাছে তিনি পরিচিত ‘ক্যাসিনো হাফিজুল’ নামে। অভিযোগ রয়েছে, অনলাইন ক্যাসিনো ও ক্রিকেট জুয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার জুয়ার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন অন্তত অর্ধশত পরিবার।
গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন টান কড্ডা কাঁঠালিয়াপাড়া এলাকায় শরিফ মোক্তারের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন হাফিজুল ইসলাম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৩ সালের দিকে গাড়ির ড্রাইভারি ছেড়ে দিয়ে অনলাইন জুয়ার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন হাফিজুল ইসলাম। শুরুতে বিভিন্ন অনলাইন ক্যাসিনো প্ল্যাটফর্মে বিটকয়েন ও ডিজিটাল ব্যালেন্স বিক্রির মাধ্যমে কমিশন নিতেন। পরবর্তীতে নিজেই সক্রিয় ভাবে ক্যাসিনো এজেন্টে পরিণত হন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ক্যাসিনো এজেন্ট হিসেবে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিকবার থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের হাতে আটক হলেও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে বারবার ছাড়া পেয়ে যান হাফিজুল।
বিশেষ করে বিটকয়েন ও অনলাইন জুয়ার ব্যালেন্স বিক্রির অভিযোগে একাধিকবার পুলিশের জালে পড়লেও কোনো মামলায় তার দৃশ্যমান শাস্তি হয়নি। প্রযুক্তির আড়ালে জুয়ার সাম্রাজ্যের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, হাফিজুলের ব্যবহৃত একাধিক উচ্চমূল্যের স্মার্টফোনে বিশেষ সফটওয়্যার ও কৌশল রয়েছে, যার মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে ক্যাসিনো অ্যাপ ও লিংক মুছে বা গোপন করা সম্ভব।
ফলে আটক হলেও তার মোবাইল ফোন থেকে জুয়ার অ্যাপ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জানা যায়, কড্ডা নামা বাজার এলাকার কয়েকটি চা- দোকান, মুদি দোকান ও ফ্লেক্সিলোড দোকানে কড্ডা হিসেবে ব্যবহার করে আইপিএল, বিপিএল ও বিগ ব্যাশসহ বিভিন্ন ক্রিকেট লীগের অনলাইন জুয়ায় কিশোর, তরুণ ও মধ্য বয়সীদের সম্পৃক্ত করা হতো।
লেনদেন পরিচালিত হতো আশপাশের বিকাশ ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এজেন্টের দোকানের মাধ্যমে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আগে কাঁঠালিয়াপাড়া এলাকায় মাদক, জুয়া খেলা ছিলো না, এখন হাতের নাগালে সবকিছু যা এলাকার যুব সমাজের ধ্বংসের রাস্তা, এর পিছনে যারা ইন্ধন দেয় তাদের সামনে এনে বিচারের সম্মুখ করতে হবে যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো থাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টান কড্ডা কাঁঠালিয়াপাড়া এলাকার একজন বলেন, সাগর নামে একজন এই এলাকায় ব্যবসা করতো। সাগর এখন নাই দেইখা হাফিজুলের ব্যবসা ভালো চলতেছে, এক চুটিয়া ব্যবসা করছে, এর লাইগা ওর বউরে চাকুরি করতে দেয় না।
সদস্য সংখ্যা কত জন জানতে চাইলে বলেন মোটামুটি ১০০ জনের মতো আছে তাও সাগরের মতো পারবো না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাফিজুলের সঙ্গে জুয়া খেলায় অংশগ্রহণকারী একজন বলেন- হাফিজুল আগে গাড়ির ড্রাইভারি করতো। ছেলে হিসেবে ভালো ছিলো, কিন্তু হঠাৎ করে আলাদীনের চেরাক পেয়ে গেলো মনে হয়।
ক্রিকেট লীগের জুয়া থেকে তিনি টাকা ইনকাম করা শুরু করার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই ব্যক্তি আরও বলেন, জুয়ার খেলার সফটওয়্যার সমন্ধে অনেক এক্সপার্ট ছিল। আমরা তার বিটে খেলতাম। বর্তমানে বেশ কয়েকটি অ্যাপসের এজেন্ট বলে জানান তিনি।
তবে হাফিজুলের মতো সৌভাগ্যবান নয় বেশিরভাগ মানুষ। এই অনলাইন জুয়ার কারণে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন টান কড্ডা এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন (ছদ্মনাম)। এই অনলাইন জুয়ার লোভে পড়ে আমি আমার সব হারিয়েছি।
এখন আমার ব্যাবসার অবস্থা বেশি ভালো না, চালান-পাতি নাই ঠিক মতো ব্যবসা করতে পারছি না। পারিবারিক ভাবে খুবই অশান্তিতে আছি, কোনো জায়গায় শান্তি খুঁজে পাই না।
প্রতিবেদককে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই হালায় এজেন্ট দুই লাখ- আড়াই লাখ টেহা হারে ওর কিছুই হয় না।
ওর বিটে আমি ২০- ২৫ হাজার টেহা খেলছি একটা দিনও টেহা নিবার পারি নাই, ওই আমার কাছে থেইকা ২৫ হাজার টেহা নিছে ওর চালান হলো ৭ হাজার টেহা, তোমরা জানো একশো জনের মধ্যে ৯৭ জনের কাম সারা ৩ জন লাভবান, এর মধ্যে যদি লাখ টেহার খেলে ওর কোনো কিছু হইবো না, ওর কাছে যে মোবাইল আছে পুলিশের বাপের শক্তি নাই যে ওর মোবাইল থেকে ক্যাসোনোর অ্যাপস পাইবো।
হাফিজুলের একটা মোবাইল আছে ১ লাখ টেহার উপরে দাম আছে, মোবাইল যদি একবার অপ করে সব শেষ, ওগো বুদ্ধি দেয় ক্যাসোনো এজেন্টের অফিস থেকে যাতে পুলিশ ধরতে না পারে
বাংলাদেশে দণ্ডবিধি ১৮৬০- এর ২৯৪ ও ২৯৫ ধারা, পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭, এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনো পরিচালনা সম্পূর্ণ অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এছাড়াও অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী অবৈধ জুয়ার অর্থ লেনদেন গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত ক্যাসিনো এজেন্ট হাফিজুল ইসলাম বলেন, আমি একসময় ক্যাসোনো চালাইতাম এখন চালাইনা এগুলো সম্পূর্ণ ভূয়া, আপনি যেটা বলছেন সেটা ঠিক আছে, বাড্ডা থেকে আমাকে যখন আটক করে সজিব ভাই, এরপর আমারে দুইবার ধরছে, আমি এগুলো এখন করি না এগুলো ভূয়া, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলছে তারা।
আমি এক সময় করতাম এখন টোটাল করি না, আমাকে ডিবি পুলিশও ধরছে, মোবাইল ফোন তিনদিন ডিবি অফিসে আটকিয়ে রাখছে তারা।
ঘটনা অস্বীকার করে জিএমপির বাসন থানার সাবেক সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) সজিব হাসান বলেন, In possible ভাই, আমি তো টঙ্গী পশ্চিম থানায় চলে গেছি, কতো লোকরে ধরি তারা কি অপরাধ করেনি, আপনি আমার সাথে সাক্ষাৎতে কথা বইলেন বলে ফোন কেটে দেন। এরপর মোবাইল ফোনে একাধিক বার ফোন দেওয়ার পরও ফোন রিসিভ করেনি
এ ব্যাপারে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ, উত্তর) এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, ক্যাসোনোর এজেন্টের বিরুদ্ধে তদন্ত করে, এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসআর