মশা কামড়ানোর কতদিন পর ডেঙ্গু জ্বর হয়, একজন কতবার আক্রান্ত হতে পারেন?
দেশে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত আগস্টের চেয়ে চলতি সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগস্টের শেষ দিক থেকে ক্রমেই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের চাপ বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৩ জনে।অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরও ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা তার চরিত্র পরিবর্তন করছে। পরিবর্তন এসেছে ডেঙ্গুজ্বরের উপসর্গেও। মানুষের মনে তাই ডেঙ্গু জ্বর ও এডিশ মশা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা জিজ্ঞাসা।এসব জিজ্ঞাসার মধ্যে অন্যতম হলো- এডিস মশা কামড়ানোর কত দিন পর জ্বর আসে? একটা এডিস মশা কত দিন বাঁচে আর কত দিন এটি ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে? ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীরে কত দিন এই জীবাণু সক্রিয় থাকে? একজন মানুষের কতবার ডেঙ্গু হয়?যুক্তরাজ্যভিত্তক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সে সম্পর্কে-এডিস মশা কামড়ানোর কতদিন পর জ্বর আসে?ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহনকারী মশার নাম এডিস এজিপ্টি। আমাদের দেশে এটি ডেঙ্গু মশা নামেই বেশি পরিচিত। এডিস মশা কামড়ানোর কারণেই ডেঙ্গু জ্বর হয়। যদিও এই মশা কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জ্বর হয় না।এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাবেরা গুলনাহার জানান, ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে লক্ষ্মণ দেখা দিতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। এই সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড।তিনি জানান, সাধারণত এডিস মশা কামড়ানোর পাঁচ থেকে সাত দিন মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর আসে। আর এই জ্বর থাকে পাঁচ থেকে ছয় দিন পর্যন্ত।আক্রান্ত রোগীর শরীরে কতদিন এই জীবাণু সক্রিয় থাকে?চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চার ধরনের সেরোটাইপ পাওয়া যায়। এগুলো হলো: ডেন - ১, ডেন - ২, ডেন - ৩ এবং ডেন - ৪। একজন মানুষ তার সারাজীবনে এই চার ধরনে সর্বোচ্চ চারবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। অর্থাৎ একবার একটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর তা সেরে গেলে, তার শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা সারা জীবনের জন্য কাজ করে।তার মানে হলো, একবার একটি ধরনে আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো ব্যক্তি আর সেই ধরনে আক্রান্ত হবেন না। এরপর যদি তিনি পুনরায় আক্রান্ত হন, সেটি হবে ডেঙ্গুর ভিন্ন কোনো ধরন।অধ্যাপক গুলনাহার বলেন, “যতদিন রক্তে ভাইরাস থাকবে, ততদিন রোগীর শরীরে জ্বর থাকবে। কেবলমাত্র রক্ত জীবাণুমুক্ত হলেই ডেঙ্গু জ্বর সেরে যায় একজন আক্রান্ত ব্যক্তির।”জ্বর সারলেই কি তিনি সুস্থ?অধ্যাপক ডা. গুলনাহার জানান, প্রথমবার ডেঙ্গু হলে অনেকেই তা বুঝতে পারেন না। সামান্য শরীর ব্যথা ও একটু জ্বরের লক্ষ্মণ থাকলেও সাধারণত এ সময় সর্দিকাশিও থাকে না। একে ব্রেকবোন ফিভারও বলা হয়। পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই এই জ্বর ভালো হয়ে যায়। তবে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে, অর্থাৎ অন্য আরেকটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরে জটিলতা তৈরি হয়।কারণ হিসেবে তিনি জানান, প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেটার সঙ্গে নতুন ভাইরাসের অ্যান্টিজেনের এক ধরনের রিঅ্যাকশন হয়। যার ফলে হেমোরেজ বা প্লাটিলেট কমে যাওয়ার মতো জটিলতা তৈরি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে, ক্ষেত্রবিশেষে প্রথমে খুব জ্বর ওঠার পর তা কমে যায়। এসময় কিছুটা সুস্থ বোধ হলেও, এটিই আসলে সবচেয়ে জটিল পর্যায়। কেননা এ সময়েই আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্লাটিলেট কমে যায় এবং রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ সময় সুস্থ বোধ করায় শিশুরাও খেলাধুলা করতে চায়। তবে এটা একেবারেই করা যাবে না। এই সময় যেকোনো ধরনের পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সম্পূর্ণ বিশ্রাম করতে হবে।এডিস মশা কতদিন বাঁচে?এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিবিসি বাংলাকে জানান, একটি পূর্ণ বয়স্ক এডিস মশা গড়ে ১৫-৪০ দিন বাঁচে। মূলত তাপমাত্রার ওপর এডিস মশার আয়ু নির্ভর করে। যেমন- শীতকালে এডিস মশা বেশি বাঁচে, আবার গরম কালে এডিস মশার বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার দ্রুত হয় বলে এসময়ে এডিস মশা কম বাঁচে।এডিস মশা কখন কামড়ায়?একসময় বলা হতো ডেঙ্গু মশা শুধুমাত্র দিনের বেলা কামড়ায়। কিন্তু সে ধারণা এখন আর কাজ করছে না। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা তার চরিত্র বদলেছে। এখন দিনে বা রাতে সব বেলাতেই কামড়াতে পারে এডিস এজিপ্টি, বিশেষ করে রাতে যদি ঘর আলোকিত থাকে।এডিস মশা কতবার কামড়ায়?কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, ল্যাবে করা পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি এডিস মশা জীবদ্দশায় গড়ে চার থেকে ছয়বার কামড়ায়। কেবল মাত্র স্ত্রী মশাই কামড়ায়। অর্থাৎ একমাত্র স্ত্রী এডিস মশাই ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করে। আর স্ত্রী এডিস মশাও কেবলমাত্র পেটে ডিম থাকা অবস্থাতে কামড়ায়।এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয়?এডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয়- এমন ধারণা অনেকের মধ্যেই প্রচলিত রয়েছে, যা সঠিক নয়। আরেকটি ভুল ধারণা হলো, আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর পর পরই সুস্থ একজনকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু জ্বর হবে।কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, এডিস মশার মাধ্যমে তখনই একজন ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হবেন, যখন মশাটি ভাইরাস ইনফেক্টেড অথবা ভাইরেমিক হবে। একটা এডিস মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড়ে যখন ভাইরাস ছড়ানোর উপযোগী হয় তখন এটাকে বলা হয় ভাইরেমিক। আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর পর ডেঙ্গু মশাকে ভাইরাস বিস্তারের উপযোগী হতে একটি জীবনচক্র পূরণ করতে হয়। অর্থাৎ আক্রান্ত কাউকে কামড়ানোর মাধ্যমে মশার দেহে ভাইরাসটি প্রবেশ করে। এরপর ডিম পারা এবং বংশবিস্তারের মাধ্যমে ওই মশা ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে সক্ষম হয়, অর্থাৎ ভাইরেমিক হয়। এরপর যতদিন মশাটি বেঁচে থাকবে ততদিন পর্যন্ত ডেঙ্গুর জীবাণু ছড়াতে পারবে। এছাড়াও জীবাণু বহনকারী ওই মশা যত ডিম পারে, তার সবগুলোতেই ভাইরাস থেকে যায়। আর সেই ডিম যদি প্রকৃতিতে অনুকূল পরিবেশ পায় তবে সেখান থেকে জন্মানো মশার কামড়েও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়াতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সওভারিয়াল ট্রান্সমিশন।ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ?ডেঙ্গু ছোঁয়াচে রোগ নয়, এটি কেবল মাত্র মশার মাধ্যমেই ছড়ায়। এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। অর্থাৎ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, একই বিছানায় ঘুমালে কিংবা তার ব্যবহৃত কিছু ব্যবহার করলে, অন্য কারো এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এডিস মশা ব্যতীত স্পর্শ বা অন্য কোনোভাবে এই রোগ ছড়ায় না। এমনকি অন্য প্রজাতির মশার মাধ্যমেও ডেঙ্গু ছড়ায় না।