এইমাত্র
  • কঠোর নিরাপত্তায় বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত
  • কঠোর নিরাপত্তায় বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত
  • যশোরে আগাম শীতকালীন সবজির বাম্পার ফলন
  • চুরি করতে গিয়ে বোনের শাশুড়িকে জবাই করে হত্যা
  • আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার ঘোষণা দিলেন শোয়েব মালিক
  • যুদ্ধাপরাধী হিসেবে নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করা উচিত: হামাস
  • কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী এমন হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে না: কাদের
  • জীবনের শেষ ভিডিওবার্তায় যা বলেছিলেন শাফিন
  • ট্রেন চলাচলের এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি: রেলওয়ে
  • এইচএসসির আরো চারটি পরীক্ষা স্থগিত
  • আজ শনিবার, ১১ শ্রাবণ, ১৪৩১ | ২৭ জুলাই, ২০২৪
    দেশজুড়ে

    'রেংমিটচ্য’ ভাষা বাঁচাতে সিংরা ম্রো তরুণের লড়াই

    আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান প্রতিনিধি প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম
    আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান প্রতিনিধি প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম

    'রেংমিটচ্য’ ভাষা বাঁচাতে সিংরা ম্রো তরুণের লড়াই

    আকাশ মারমা মংসিং, বান্দরবান প্রতিনিধি প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম

    পাহাড়চূড়ায় থাকা একটি ঘরে মাঝ বয়সী একজনকে কেন্দ্র করে ওপর গোল হয়ে বসেছে শিক্ষার্থীরা। এই দলে শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সীরা আছে। সংখ্যাটা ৩০ জনের মতো হবে। ভাষা শেখানো মনোযোগের কেন্দ্রে থাকা ভদ্রলোকই সিংরা ম্রো। এখন রেংমিটচ্য, ম্রো এবং বাংলা—এই তিনটি ভাষা জানেন। বাংলাতেই বললেন, ‘আমাদের পাড়ার সবাই দিনভর চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই সন্ধ্যার পর পড়াই। প্রাথমিকভাবে নিজেদের নাম, মা-বাবার নাম, ফুল, ফল, প্রাণী ইত্যাদির নাম এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ছোট ছোট বাক্য শেখাচ্ছি।’

    'রেংমিটচ্য’ ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা মোট ছয়জন। দুজন নারী, চারজন পুরুষ। সবার বয়স ষাটের উর্ধ্বে। থাকেন বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে। তাঁরা যে ভাষায় কথা বলেন এর নাম ‘রেংমিটচ্য’। গোটা পৃথিবীতে এই ভাষা জানা জীবিত মানুষ এখন তাঁরা এই ছয়জনই। কখনো এক সঙ্গে মিলিত হতে পারেননি তাঁরা। মাঝে মধ্যে দুইজন আবার কখনো তিনজন। তবে দেখা কিংবা সাক্ষাৎ হলে তাঁরা রেমিটচ্যা ভাষায় কথা বলেন। আর সেসব মানুষদের না পেলে সবাই ম্রো ভাষায় কথা বলা শুরু করেন। এই মানুষগুলো মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে রেংমিটচ্য ভাষাটি!

    ছয়জন হলেন- আলীকদমের দুর্গম ক্রাংসিপাড়ার বাসিন্দা মাংপুন ম্রো, কুনরাও ম্রো ও আরেক কুনরাও ম্রো এবং নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মেনসিংপাড়ার বাসিন্দা থোয়াং লক ম্রো। অন্যদুজন নাইক্ষ্যংছড়ির ওয়াইবটপাড়ার রেংপুন ম্রো ও কাইংওয়াইপাড়ার মাংওয়াই ম্রো।

    রেংমিটচ্য ভাষাটি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবার সুড়ঙ্গের শেষে আলোর দেখা মিলেছে। এই ছয়জনের জানা থাকা ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা বাঁচাতে এক তরুণের লড়াই করছে। এরই মধ্যে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শ্রুতির আড়ালে থাকা ভাষাটিকে বাঁচাতে শুরু হয়েছে রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। ম্রো জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের নিয়ে গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে চলছে এই কার্যক্রম। ছয়জনের ভাষা বাঁচাতে এক তরুণের লড়াই বান্দরবানের আলীকদমের দুর্গম ক্রাংসিপাড়ায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিশুদের রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষার ক্লাস করান সিংরা ম্রো নামের এই তরুণ।

    বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার দুর্গম এলাকার ক্রাংসিপাড়ার বাসিন্দা সিংরা ম্রো। সড়কপথে গ্রামটিতে যাওয়ার উপায় নেই। আলীকদম উপজেলার সদর ইউনিয়ন থেকে তৈনখালের উজানের দিকে মিনিট চল্লিশের মতো ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে বাঁশফুল ঝিরি হয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মতো হেঁটে গেলে ক্রাংসিপাড়া।

    ‘সিংরা ম্রো’ তিনি রেংমিটচ্যভাষী মাংপুন ম্রোর ছেলে। তাঁর বাবা অনর্গল রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতে পারেন। কিন্তু সিংরা ভাষাটি ভালো জানতেন না। কয়েক বছর হলো শিখেছেন। এখন সেটাই ছড়িয়ে দিতে চাইছেন প্রজন্মান্তরে। যেন বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, বাপ-দাদার ভাষাটি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে দেননি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছেলে-বুড়ো শিখছেন নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভাষাটি। তবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভাষাটিকে বাঁচাতে শুরু হয়েছে রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম।

    তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় সিংরা ম্রো। মা-বাবা দুজনই জুম চাষি। সংসারে অভাব লেগেই থাকত। কষ্টেসৃষ্টে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। পরে জুম চাষি হয়েছেন। বাবা মাংপুন ম্রো রেংমিটচ্য ভাষী হলেও সিংরা ভাষাটি ভালো জানতেন না। বছর পাঁচেক আগের কথা। বর্ষাকাল। জুমে কাজ করে ফেরার সময় পা পিছলে পাহাড় থেকে পড়ে যান মাংপুন ম্রো। সিংরা কাঁধে করে তাঁকে বাড়ি নিয়ে এলেন। কিছুদিন পর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি সিংরাকে ডেকে বললেন, ‘আমি আর কদিন আছি। মরার আগে একটা আফসোস রয়েই গেল। তোরা রেংমিটচ্য ভাষাটা শিখলি না। আমি না থাকলে আমার ভাষাটাও নাই হয়ে যাবে!’

    তার শয্যাশায়ী বাবার এই আফসোসে খুব করে পুড়ে ছিল সিংরার মন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি বাবার কাছ থেকে রেংমিটচ্য ভাষাটা রপ্ত করলেন। পরে ভাবলেন, পাড়ার শিশুদেরও ভাষাটি শেখাবেন। মাস দুয়েক আগে এক সন্ধ্যায় পাড়ার সবাইকে ডাকলেন। তত দিনে রেংমিটচ্য ভাষার প্রথম অভিধানও প্রকাশিত হয়ে গেছে। সিংরা বললেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ভাষাটি যতটুকু পারি সবাইকে সহজ করে শেখাতে চাই। তোমরা শিখতে চাও কি না?’ শুধু ছোটরা নয়, সেখানে উপস্থিত বড়রাও বললেন, ‘আমরা আসব।’

    সিংরা ম্রো সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি জানান, রেংমিটচ্যা ভাষাটিকে বাঁচাতে তিনি পরামর্শ করেছিলেন ইয়াংঙান ম্রোর সঙ্গে। তিনিও উৎসাহ দিলেন। শিশুদের খাওয়ানোর জন্য দিলেন দুই হাজার টাকা। ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সিংরার মাচাং ঘরের পাটাতনে শুরু হলো রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। প্রথম দিন এসেছিল ১৫ জন শিশু। এখন রেংমিটচ্য ভাষার পাঠ নিতে আসে ৩৫ জন। শিশুদের পাশাপাশি বড়রাও শামিল হন। পাঠশালা চালুর পর থেকে শিশুরা ধীরে ধীরে রেংমিটচ্য ভাষায় আগ্রহী হচ্ছে । যত দিন বেঁচে আছেন কাজটি চালিয়ে যাবেন। শুরুতে পাড়ার ছেলেমেয়েদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা শব্দগুলো শেখাচ্ছি। উচ্চারণে কোনো ভুল হলে ঠিক করে দেওয়ার জন্য আমাদের বাবারা রয়েছেন। আমাদের পাড়ার বাইরে যে তিনজন রেংমিটচ্যভাষী রয়েছেন তাঁদেরও নিয়ে আসার পরিকল্পনা আছে। একসঙ্গে থেকে তাঁরা যাতে নিয়মিত কথোপথন চালিয়ে যেতে পারেন।’

    সিংরা ম্রো জানান, শুরু থেকেই সিংরার এই উদ্যোগে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। গত বছর রেংমিটচ্য ভাষার প্রথম অভিধান লিখেছিলেন তিনি। মূলত ‘মিটচ্যতখক’ নামের ৩৪০০ শব্দের সেই অভিধানকে ভিত্তি ধরে এখন ভাষাটা শেখানো হচ্ছে।

    সিংরা ম্রো বলেন, ‘রেংমিটচ্য আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাষা। কিন্তু এখন বাবা ছাড়া মাত্র পাঁচজন ভাষাটি বলতে পারেন। তাই তাঁরা জীবিত থাকতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে বয়স্করা মারা গেলেও ভাষাটি না হারায়।’

    রেংমিটচ্যভাষী সত্তর বয়সী মাংপুন ম্রোর বললেন, ‘আমাদের তো চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। আমরা মারা গেলে ভাষাটা হারিয়ে যাবে—এ নিয়ে এত দিন চিন্তায় ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, বংশপরম্পরায় ভাষাটা টিকে থাকবে।’

    ইয়াংঙান ম্রো জানালেন, ‘সিংরার সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তবু তিনি ভাষা বাঁচানোর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই এখন দরকার সরকারি সহায়তা। পাড়ায় একটি স্কুল করে রেংমিটচ্য ভাষার চর্চাটা স্থায়ী রূপ দেওয়া দরকার। না হলে ব্যক্তি উদ্যোগ একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। বাংলাদেশ তথা পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে আরো একটি ভাষা!

    ম্রো ভাষা লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বললেন, “চোখের সামনে একটা ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে এটা মানতে পারিনি। তাই ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ‘মিটচ্যতখক’ এ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীতপতঙ্গ, খাদ্য, খেলাধুলা, সংখ্যা, দিন ও মাসের নাম রাখা হয়েছে। রেংমিটচ্য ভাষার বাক্যও আছে। প্রাথমিক পর্যায়ে সবাইকে এগুলো শেখানো হচ্ছে।”

    ভাষা প্রযুক্তিবিদ সমর এম সরেন জানান, পাহাড়ের যে কয়টি মাতৃভাষা ও বর্ণমালা রয়েছে সেগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য গ্রামের সচেতনব্যক্তি কিংবা সকলকে সমন্নিত উদ্যেগ দরকার। তবেই ভাষা কিংবা বর্ণমালা যুগের পর যুগ টিকে থাকবে।

    পিএম

    ট্যাগ :

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    সর্বশেষ প্রকাশিত

    Loading…