এইমাত্র
  • দেশের সব নির্বাচন অফিসে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
  • স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ, স্ত্রী ও প্রেমিক আটক
  • রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্দে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা চান এরদোয়ান
  • ওসমান হাদির ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করছে না বিএনপি
  • ছুটির দিনেও খোলা থাকবে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়
  • ওসমান হাদির ওপর হামলার পর পানছড়ি সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার
  • ১২ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি জাবালে নূর টাওয়ারের আগুন
  • চট্টগ্রাম-১৫ আসনে বিএনপি’র প্রার্থীকে জরিমানার পর শোকজ
  • আফগানিস্তানকে ৩ উইকেটে হারাল বাংলাদেশ
  • ডেঙ্গুতে একদিনে আক্রান্ত ৫৭২
  • আজ রবিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
    তথ্য-প্রযুক্তি

    মাদকপথের নতুন ঠিকানা, ইলিয়াস-নবীর ‘৮ সিস্টার সিন্ডিকেট’

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৫ পিএম
    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৫ পিএম

    মাদকপথের নতুন ঠিকানা, ইলিয়াস-নবীর ‘৮ সিস্টার সিন্ডিকেট’

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:১৫ পিএম

    মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের অন্যতম আলোচিত নাম মো. ইলিয়াস। মাদক ব্যবসার জগতে তিনি পরিচিত ‘ইয়াবা সম্রাট’ নামে। উখিয়ার সীমান্ত ঘেষা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যমপাড়া গ্রামের এই যুবক এখন কোটি টাকার সম্পদের মালিক। অথচ মাত্র ক'বছর আগেও তার পরিবার ছিল সাধারণ এক কৃষক পরিবার।

    অনুসন্ধানে জানা গেছে, পেছনের ছায়া চরিত্র ইলিয়াসের বাবা ফজল মেম্বার নিজেও এলাকায় কুখ্যাত এক মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। এক সময় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তার বড় ভাই আব্দুর রশিদ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ছত্রছায়ার সুযোগে তাদের পরিবার গড়ে তোলে শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট।

    এলাকাবাসী বলছে, ইলিয়াসদের পরিবারের আট সদস্যকে নিয়ে গড়ে ওঠে এক ‘৮ সিস্টার সিন্ডিকেট’, যারা সীমান্ত থেকে ইয়াবার চালান দেশে প্রবেশ করানোর মূল রুটটি নিয়ন্ত্রণ করে। ইলিয়াসের চাচা আব্দুলকেও ইয়াবাসহ চট্টগ্রামে একাধিকবার গ্রেফতার হয়। পরিবারটির প্রায় প্রতিটি সদস্য কোনো না কোনোভাবে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা সচেতন মহলের।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের শেষের দিকে সীমান্তের আরেক কুখ্যাত গ্রুপ নবী হোসেনের সঙ্গে আঁতাত করে ইয়াবা কারবারে নতুন মাত্রা যোগ করেন ইলিয়াস। তার মাদক সাম্রাজ্যের বিস্তারে সহায়তা করে ফেনসিডিল ও ইয়াবার ৪-৫টি নতুন রুট। ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট, এক বিশাল চালানে ৪ লাখ ২০ হাজার ইয়াবাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি।

    জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ইলিয়াস নিজেকে আড়াল রাখলেও থেমে থাকেননি। কক্সবাজার কাস্টমস এলাকায় হক মার্কেট নামে একটি ব্যবসা স্থাপন করেন। একই সঙ্গে, কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকার হোটেল হাই পেরিয়ানের আংশিক মালিকানা এবং ভাই রশিদের ‘কে আর এস ইটভাটা’র শেয়ারদারি অর্জন করেন। অথচ তার নিজের নামে দৃশ্যমান কোনো বৈধ ব্যবসা নেই।

    অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পৈতৃকভাবে তেমন সম্পদ ছিল না। অথচ এখন কোটিপতি ইলিয়াস। কোটি টাকার বাড়ি, দামি গাড়ি, জমি-জমা কিনে ফেলেছেন একের পর এক। স্থানীয় সূত্র বলছে, এগুলোর বেশিরভাগই স্ত্রীর কিংবা আত্মীয়স্বজনের নামে। চলতি বছরের ১৪ আগস্ট, তার সহযোগী আবু বক্করসহ আরও ৩ সহযোগী ইয়াবাসহ আবারও আটক হয়। অথচ মূলহোতা ইলিয়াস ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

    অনুসন্ধান বলছে, নবী হোসেন ও মো. ইলিয়াসের মাদক সাম্রাজ্যের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে অর্ধশতাধিক প্রশিক্ষিত যুবকের একটি দল। এদের অধিকাংশই স্থানীয়, যাদের প্রধান কাজ হলো সুযোগ বুঝে মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করে সেখান থেকে ইয়াবার চালান সংগ্রহ করা। এসব যুবক প্রতিরাতে সীমান্ত অতিক্রম করে মাদক বোঝাই করে ফিরে আসে এবং ইলিয়াসের নিয়ন্ত্রণাধীন গোপন আস্তানায় মজুদ করে। পরে সেখান থেকেই পরিকল্পিতভাবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইয়াবার সাপ্লাই দেওয়া হয়। এই যুবক দলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এক সুসংগঠিত ট্রানজিট নেটওয়ার্ক, যার প্রতিটি স্তরই নজরদারির বাইরে থেকে যায় প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায়।

    স্থানীয় সাংবাদিক, শিক্ষক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ বলছেন, “এই ব্যক্তি কীভাবে বারবার আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে? কারা তাকে রক্ষা করছে? সীমান্তবর্তী এলাকা হয়ে উঠছে ইয়াবার অভয়ারণ্য।”

    ঘুমধুমের এক মসজিদের ইমাম বলেন, “ইলিয়াসের মত লোকদের জন্য আজ আমাদের যুবসমাজ ধ্বংস হচ্ছে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এমন চক্র ভাঙা সম্ভব নয়।”

    ইলিয়াসের বিশাল ইয়াবা সিন্ডিকেটসীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে মো. ইলিয়াসের নেতৃত্বে গড়ে উঠা '৮ সিস্টার সিন্ডিকেট' নামে পরিচিত চক্রটি মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান এনে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে। ইলিয়াসের পরিবারের সদস্যরাই এই সিন্ডিকেটের মূল চালিকাশক্তি, যারা নানা ছদ্মবেশে ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে এ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের রয়েছে নিজস্ব বাহিনী, পাহারা দল এবং চালান ব্যবস্থাপনা দল। সীমান্ত, পরিবহন এবং নিরাপত্তা—সবকিছুতেই তাদের আলাদা লোক রয়েছে। এক কথায়, ইলিয়াসের সিন্ডিকেট এখন একটি সুসংগঠিত অপরাধী নেটওয়ার্কে রূপ নিয়েছে।

    সীমান্ত দিয়ে দেশে ঢোকানো ইয়াবার বড় একটি অংশ সরাসরি চলে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক মাদক চক্রের নিয়ন্ত্রণে।

    অনুসন্ধান ও একাধিক সূত্রে জানা যায়, ইলিয়াসের সিন্ডিকেটের মাদক চালানগুলোর গন্তব্য হয় সাধারণত উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো, যেখানে অপেক্ষা করে থাকে ক্যাম্পভিত্তিক একাধিক ইয়াবা গডফাদার। এসব গডফাদারদের হাতে নিরাপদে ইয়াবা পৌঁছে দিতে ইলিয়াসের আলাদা ডেলিভারি নেটওয়ার্ক রয়েছে। ক্যাম্পের ভেতর থাকা কিছু চিহ্নিত রোহিঙ্গা কারবারি এসব মাদক গ্রহণ করে তা আবার দেশের ভেতর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই সীমান্ত পেরিয়ে আসা ইয়াবা দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে ক্যাম্পকেন্দ্রিক গডফাদারদের মাধ্যমে, যেখানে ইলিয়াস শুধুমাত্র একটি বড় সরবরাহকারী চক্রের নিয়ামক হিসেবেই কাজ করছে।

    নবী হোসেন-ইলিয়াস: সীমান্ত সাম্রাজ্যের দুই মুখ:

    মিয়ানমারে নবী হোসেন যতটা ভয়ংকর, বাংলাদেশ অংশে ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর মো. ইলিয়াস। নবী হোসেনের পার্টনার হিসেবে ইলিয়াস এখন সীমান্তের অপরিহার্য অংশ। এদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চলা সাম্রাজ্য এখন মিয়ানমার-বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে গড়ে তুলেছে এক অদৃশ্য করিডোর। এই মাদক করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই প্রতিটি রুটে মোতায়েন থাকে ভাড়াটে পাহারাদার, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা।

    সচেতন মহলের ভাষ্য, “মো. ইলিয়াস এখন শুধু মাদক ব্যবসায়ী নন—তিনি এই সীমান্ত করিডোরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রক। যেভাবে নবী হোসেন মিয়ানমারে ত্রাস ছড়ায়, ঠিক সেভাবেই ইলিয়াস সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে ভয়ঙ্কর এক যমজ প্রতিপক্ষ। প্রশাসন যদি এই জাল না ছিঁড়ে, তবে কেবল উখিয়া বা ঘুমধুম নয়—সমগ্র বাংলাদেশকে ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়তে হবে।”

    তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন মো. ইলিয়াস। তিনি দাবি করেন, মাদকের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই এবং তিনি কিছুই জানেন না। ২০২৪ সালের ২৭ আগস্ট ৪ লাখ ২০ হাজার ইয়াবাসহ সহযোগীদের গ্রেফতারের ঘটনাকে ‘চক্রান্ত’ আখ্যা দিয়ে ইলিয়াস বলেন, “আমাকে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে।”

    উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আরিফ হোসেন বলেন, “কোনো অপরাধীকে উখিয়ায় আশ্রয় দেওয়া হবে না। আমরা তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। কাউকে হাতে-নাতে ধরতে পারলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

    ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক হোসেন খান জানান, “সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার রয়েছে। পাচারকারীরা বিভিন্ন অপকৌশলে মাদক ও পণ্য পাচার করার চেষ্টা করছে। তবে আমাদের নিয়মিত অভিযানে অনেক সময় জব্দ ও আটক সম্ভব হচ্ছে।”

    এমআর

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    Loading…