এইমাত্র
  • দেশের সব নির্বাচন অফিসে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
  • স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ, স্ত্রী ও প্রেমিক আটক
  • রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্দে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা চান এরদোয়ান
  • ওসমান হাদির ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করছে না বিএনপি
  • ছুটির দিনেও খোলা থাকবে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়
  • ওসমান হাদির ওপর হামলার পর পানছড়ি সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার
  • ১২ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আসেনি জাবালে নূর টাওয়ারের আগুন
  • চট্টগ্রাম-১৫ আসনে বিএনপি’র প্রার্থীকে জরিমানার পর শোকজ
  • আফগানিস্তানকে ৩ উইকেটে হারাল বাংলাদেশ
  • ডেঙ্গুতে একদিনে আক্রান্ত ৫৭২
  • আজ রবিবার, ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ | ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    কিশোরগঞ্জের হাওরে ধান কাটার ধুম, দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

    সাব্বির হোসেন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২৬ পিএম
    সাব্বির হোসেন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২৬ পিএম

    কিশোরগঞ্জের হাওরে ধান কাটার ধুম, দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

    সাব্বির হোসেন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২৬ পিএম

    কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলসহ পুরো জেলায় শুরু হয়েছে ধানকাটা উৎসব। হাওরের পাড়ে পাড়ে কিষান-কিষানীর যুথবদ্ধ কর্মচাঞ্চল্যে সরব ও মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি জনপদ। এ যেনো এক অন্যরকম উৎসব। নতুন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। দল বেঁধে ধান কাটছেন দাওয়ালো হিসেবে পরিচিত হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক।

    প্রখর রোদে কপাল বেয়ে পড়ছে ঘাম। তবুও যেন খুশির শেষ নেই। অন্যদিকে হাওরের পাড়ে বা বাড়ির সম্মুখস্থ বিশাল চত্বরে ধানমাড়াই, ধান শুকানো ও শুকনো ধান ঝেড়ে গোলায় তোলার নান্দনিক আয়োজন পুরো হাওর জনপদে তৈরি করেছে উৎসবের সমারোহ। এ আয়োজন অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় এবার একটু বেশিই মনে হচ্ছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে ধানের দাম নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকের।

    কৃষকরা জানান, জমিতে ধান লাগানো থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, ধান বিক্রি করে তা দিয়ে পোষায় না। বর্তমানে ভেজা ধান সাড়ে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। এদিকে ব্যবসায়ীরা জানান, ভেজা ধান কেনার পর তাদের শুকাতে হচ্ছে। তাই বর্তমানে ধানের দাম কম। এছাড়া মিল মালিকরা এখনও ধান কেনা শুরু না করায় কৃষকরা বাজারে ভালো দাম পাচ্ছেন না।


    এসব অঞ্চলে এমন কৃষকও আছেন যাদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ তিন থেকে চার হাজার মণও ছাড়িয়ে যায়। সব ধান সংরক্ষণ করার মতো ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে পরিবারের বাৎসরিক খোরাকি রেখে বাকি ধান মাড়াইস্থলেই বিক্রি করে দেন। এ সময় দূর-দূরান্তেরের মহাজন ও চাতাল মালিকেরা ধান কেনার জন্য হাওরাঞ্চলে ভীড় জমান। বোরো ফসলকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই কৃষকদের মধ্যে আনন্দ-উদ্দীপনার অদ্ভুত শিহরন জেগে ওঠে।

    বোরো মওসুমে জিরাতির সমাগমও বেড়ে যায়। যারা কৃষকের জমি টাকার বিনিময়ে পত্তন নিয়ে চাষ করেন তাদেরকে বলা হয় জিরাতি। এই জিরাতিরা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। তারা ফসল কাটার মওসুমে জমির পাশে ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর তুলে সেখানে রাত্রিযাপন করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রয়োজনীয় সংখ্যক কৃষিশ্রমিক। এই সকল জিরাতি ও কৃষিশ্রমিকেরাও এ মওসুমে প্রচুর ধান পেয়ে থাকেন। এছাড়া এই মৌসুমী ধানের বিনিময়ে কৃষকের জমিতে ধানকাটার জন্য সুদূর ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, শেরপর, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা থেকেও দরিদ্র কৃষিশ্রমিকেরা হাওরের বিভিন্ন উপজেলায় এসে অস্থায়ী ডেরা তুলে বসবাস করেন। মৌসুমের শেষে ধানকাটার পারিশ্রমিক হিসেবে এরাও পেয়ে থাকেন প্রচুর পরিমাণ ধান।

    প্রতি বছর চৈত্র-বৈশাখ এলেই কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশংকা কাজ করে। ঘরে ফসল না তোলা অবধি তারা আশংকামুক্ত হতে পারেন না। এবারও কৃষকেরা সে আশংকার বাইরে ছিলেন না। তবে এ বছর প্রকৃতি কৃষকদের প্রতি বিরূপ ছিল না। আশংকা থাকলেও এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের কোথাও বড় ধরনের ঝড়-ঝপ্তা, অকাল বন্যা কিংবা শিলাবৃষ্টি হয়নি। ফলে বিশাল-বিস্তীর্ণ হাওরের বোরো জমিতে এবার যেন প্রকৃতিমাতা দু'হাত উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন কৃষকের বহু কাঙ্ক্ষিত সোনালী ফসল। যেদিকেই চোখ যায় সোনারং ধানের উজ্জ্বল ঝিলিক দৃষ্টির সীমানায় ঝলমলে আলো ছড়িয়ে দেয়। সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি।

    অনেক জমিতে দেখা যায় দিনমজুরেরা চিরায়ত কাস্তে হাতে ধান কাটছেন, অনেকে আবার ধান কাটার কাজ সারছেন হারভেস্টার মেশিনের সাহায্যে। এবারের মওসুমে সারা দেশের ন্যায় কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকাতেও ছিল তীব্র তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহ জনজীবনে অস্বস্তি তৈরি করলেও বোরো চাষীদের ভাগ্যে নিয়ে আসে প্রকৃতির লক্ষীমীমন্ত আশীর্বাদ। রৌদ্র আর গরমের প্রখরতায় এ বছর মাঠের ধান পরিপুষ্ট হওয়ার যেমন সুযোগ পেয়েছে তেমনি মৌসুমের শুরুতেই জমির ফসল পেকে গিয়েছে। ফলে এ বছর কিশোরগঞ্জের ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন হাওরসহ নিকলী, বাজিতপুর, তাড়াইল, করিমগঞ্জ, কটিয়াদী এবং উজান এলাকার অন্যান্য উপজেলায়ও বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।


    এদিকে সূর্যের প্রখরতা যেন আগুনের হলকা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে গায়ে ফোসকা পড়ার অবস্থা। এই আগুনে সূর্যের নিচে মাঠভরা বোরোধান। ৮০ ভাগ পাকলেই ধান কাটার তাগিদ ছিল কৃষি বিভাগের। এই কড়া রোদ উপেক্ষা করে সেই কাজটিও করে দেখিয়েছেন হাওরের কৃষক। গরমে কষ্ট হলেও আর কিছু দিন এমন রোদও চান তারা, যেন শতভাগ ধান গোলায় উঠাতে পারে।অন্যদিকে ধান সংগ্রহের জন্য মাঠে ভিড় করছে এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। তারা মাঠ ও গোলা থেকে নতুন ধান সংগ্রহ করে মজুত করে বাড়তি ফায়দা লোটার পাঁয়তারা করছে। একইসঙ্গে রয়েছে পাওনাদার-দাদনদারদের সুদের অর্থের তাগিদ। এ যেন আনন্দোৎসবে বেদনার বাঁশি বেজে ওঠার পরিস্থিতি। সরকার ধান-চালের মূল্য নির্ধারণ করে ক্রয় অভিযান শুরুর ঘোষণা দিলেও বাস্তবে সরকারি ধান-চাল ক্রয়কেন্দ্রগুলো এখনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চাষিরা।

    জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় এক লাখ ৬৮ হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ হেক্টরই হয়েছে হাওড়েরর তিন উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামে। আর উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে সাত লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন চাল। কৃষি বিভাগ বলছে, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

    এদিকে ধান কাটার পাশাপাশি ধানের কেনাবেচাও শুরু হয়ে গেছে। বাল্কহেড ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রতিদিন শত শত মণ ধান আসছে করিমগঞ্জের চামড়াঘাটের আড়তগুলোতে। সেখানে কৃষক দুলাল মিয়া বলেন, ‘ধারকর্জ করে এবার চার একর জমিতে বোরো চাষ করেছি। এবার ভালো ধান হয়েছে। তবে প্রতিদিন দাম একটু করে কমছে। ঋণের টাকা পরিশোধ ও শ্রমিক খরচ মেটাতে শুরুতে কিছু ধান বেচতে হয় আমাদের। কিন্তু আড়ত মালিকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দাম কম দিচ্ছেন। ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০০ টাকা মণ দরে। অথচ এক মণ ধান চাষে খরচ হয়েছে এক হাজার টাকারও বেশি।

    সরেজমিনে বিস্তীর্ণ হাওরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বোরো বাম্পার ফলনে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার হাট-বাজার, মাঠ-ঘাট, বাড়িঘরে শিল্পী মোমতাজসহ অন্যান্য লোকজ শিল্পীদের গান বাজছে। ধানে ধানে বাড়িঘর, আঙিনা ভরা। কৃষকের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। কেউবা গান শুনছে, কেউবা গান গাইছে। পাশপাশি ধান কাটার কাজও করছে। দোকানিরা পণ্যের পসরা সাজিয়ে করছেন বেচাকেনা। এ যেন স্বপ্নের সোনালী ধানের বাংলাদেশ। ফাল্গন-চৈত্রের অভাব আর ক্ষুধার যন্ত্রণা কিষাণ-কিষাণী ভুলে গিয়ে সোনালী ধান ভরছে তাঁর গোলায়। একসঙ্গে চলছে ধান কাটা, মাড়াই, শুকানো ও ভাঙানোর (চাল তৈরীর) কাজ। গ্রামে গ্রামে এখন এমন অভতপূর্ব দৃশ্য। এ যেন বোরো ধানের বাম্পার ফলনে কৃষকের পাল্টে যাওয়া জীবনের জয়গান। টোপা বোরো ধানের সুঘ্রাণ, চ্যাপা-শুটকীর ভর্তায় খাওয়ার ধুম লেগেছে হাওরের গ্রামগুলোতে। দাওয়াল ওকুষাণ-কৃষাণীর দল মাঠে তপ্ত দুপুরে চ্যাপা শুটকি দিয়ে নতুন ধানের ভাত খেয়ে ফূর্তিতে কাজ করছে।

    কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাদিকুর রহমান বলেন, হাওরে এখন পুরোদমে বোরো ধান মাড়াই চলছে। পাকা ধান দ্রুত কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে ক্ষতি না করতে পারে। ইতিমধ্যে পুরো জেলায় ২৫ ভাগ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাওড়ে ধানকাটার পুরোপুরি ধুম পড়বে আগামী সপ্তাহ থেকে। কাস্তের পাশাপাশি ৬ শতাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টর মেশিন দিয়ে চলছে ধান কাটা। আবহাওয়ার খারাপ কোনো পূর্ভাবাস এখনও পাইনি। এভাবে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে আর কিছু দিনের মধ্যেই শতভাগ ধান ঘরে উঠবে।

    এসআর

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    Loading…