চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মো. ফারজাদ হোসেন সজীব (৩২) নামে এক কয়েদির রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আবারও আলোচনায় এসেছে কারা ব্যবস্থার অন্ধকার দিক।
নিহতের পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ, আইন অনুযায়ী যেখানে নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল থাকার কথা, সেখানে খোদ নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরেই গড়ে উঠেছে এক প্রকার ‘অভ্যন্তরীণ অপরাধ চক্র’।
শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) দুপুর ২টার দিকে সজীবের মৃত্যু হয়। পরে মরদেহের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রলিতে রঙিন গেঞ্জি পরিহিত মরদেহ। তার হাতে ও মুখে জখমের চিহ্ন।
নিহত ফারজাদ হোসেন সজিব চট্টগ্রাম নগরীর ৩৫ নম্বর বক্সীরহাট ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ছিলেন। ঈদুল ফিতরের চার দিন আগে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, ২৫ এপ্রিল, শুক্রবার দুপুর প্রায় ১টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন সজিব। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত করতে না পেরে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা সময়ের কণ্ঠস্বর-কে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. ইকবাল হোসেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না বলেও জানানো হয়েছে।
তবে সজিবের মৃত্যু নিয়ে এক ভিন্ন ও গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন তার চাচা আবু তালেব। সময়ের কণ্ঠস্বর-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “দুপুরে একটি অচেনা নাম্বার থেকে সজিবের স্ত্রীর ফোনে কল আসে। বলা হয়, সজিব স্ট্রোক করেছে, এনআইডি কার্ডের কপি দ্রুত পাঠাতে হবে। দশ মিনিট পর আমি সেই নাম্বারে কল দিলে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘সজিব অন্য কয়েদির সঙ্গে মারামারি করে মাথায় আঘাত পেয়েছে। বিশ হাজার টাকা পাঠান, নইলে ওকে আরও মারধর করা হবে।’ আমি প্রশ্ন করি—এখনো কিছুক্ষণ আগে তো বললেন স্ট্রোক হয়েছে, এখন বলছেন মারামারি? তখনই তারা বিকাশে টাকা চায় এবং পরে লাইন কেটে দেয়।”
সদ্য কারামুক্ত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের কণ্ঠস্বর-কে জানান, “কারাগারের ভেতরে সক্রিয় ‘টাকার খেলা’—নতুন নয়, কৌশল বদলেছে!”
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ নতুন নয়। সময়ের কণ্ঠস্বর-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এর আগে অন্তত ছয়টি ঘটনায় বন্দিদের পরিবারকে ভয় দেখিয়ে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের নজির পাওয়া গেছে।
“নতুন বন্দিদের ভয় দেখানো, তাদের পরিবারকে বিভিন্ন গল্প বলে টাকা দাবি করা এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এই কর্মকাণ্ড চালানো একটি সুগঠিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হয়ে থাকে।” এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের কোনো অংশ জড়িত কি না, তা কখনোই তদন্তের মুখ দেখেনি।
সূত্র বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তত ১৭ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মৃত্যু ‘স্বাভাবিক’ বলে দেখানো হয়েছে। বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ‘আত্মহত্যা’ কিংবা ‘অসুস্থতা’ উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পায়নি।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাক্তন এক কর্মকর্তা সময়ের কণ্ঠস্বর-কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অনেক সময় অভিযোগ তদন্ত হয়ই না, আবার প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ না করেও ‘ফাইল ক্লোজ’ করে ফেলা হয়।”
এসকে/আরআই