এইমাত্র
  • কবি নজরুলের পাশে সমাহিত করা হবে ওসমান হাদিকে
  • ঈশ্বরদীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২
  • ঢাকায় পৌঁছেছে হাদির মরদেহ
  • ঝিনাইদহে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান
  • ছায়ানটে হামলাকারীদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে: সংস্কৃতি উপদেষ্টা
  • চৌহালীতে নিম্নমানের ইট দিয়ে রাস্তা তৈরির অভিযোগ
  • সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় জামালপুরের টোকন নিহত
  • জয়পুরহাটে চোর সন্দেহে যুবককে পিটিয়ে হত্যা
  • কেরানীগঞ্জে গাঁজাসহ মাদককারবারি গ্রেপ্তার
  • বড়াইগ্রামে ভুয়া সাংবাদিক দম্পতির বিরুদ্ধে পৃথক এজাহার
  • আজ শুক্রবার, ৫ পৌষ, ১৪৩২ | ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    সরকারি জমিতে দখলদারদের দাপট, আদালতের আদেশও থামাতে পারছে না

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম
    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম

    সরকারি জমিতে দখলদারদের দাপট, আদালতের আদেশও থামাতে পারছে না

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম

    কক্সবাজারের সৈকতের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট ‘সুগন্ধা পয়েন্ট’। এখানকার প্রবেশপথের বাঁ পাশে রয়েছে একটি সরকারি খাসজমি। চারপাশে টিনের ঘেরা, বাইরে সাঁটানো হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড-সব দেখে মনে হবে এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ, কোনো কাজকর্ম চলছে না। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। টিনের বেড়ার আড়ালে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে চলছে শতাধিক দোকানঘর নির্মাণের কাজ। ৮০ থেকে ১০০টির মতো পাকা দোকানঘর প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাইরে নিষেধাজ্ঞার সাইন, আর ভেতরে কোটি টাকার অবৈধ বাজার তৈরি- এ যেন সরকারি জমি দখলের এক নির্লজ্জ মহোৎসব।

    সরেজমিনে দেখা যায়, সুগন্ধা পয়েন্টের দক্ষিণ পাশে টিন দিয়ে ঘেরা বিশাল এলাকাটিতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে টানটান কর্মচাঞ্চল্য। টিনের সবুজ গেটের ওপরে লেখা, 'এই প্রতিষ্ঠান সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, হাইকোর্টের আদেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, উন্নয়ন কাজ চলিতেছে। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ।' পাশেই ঝুলছে জেলা প্রশাসনের সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি- মৌজা ঝিলংজা, বি.এস খতিয়ান নং-১, দাগ নং-২০০০৩, জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৩ একর। পাশাপাশি সাঁটানো আরেকটি বোর্ডে লেখা হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং-১০৬৫৭/২০২৪, রিটকারী সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের নাম।

    তবে টিনের ঘেরার আড়ালে বাস্তব চিত্র একেবারে ভিন্ন। কিছুটা দূরে একটি হোটেলের ছাদ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, পাঁচটি সারিতে দোকানঘর গড়ে উঠছে। তিনটি সারিতে দুইমুখী, দুটি সারিতে একমুখী দোকান। প্রতিটি দোকানের আয়তন প্রায় ৮০ স্কয়ার ফুট। মজার ব্যাপার হলো- কাজের গতি এত দ্রুত যে অনেক দোকানের ভেতর টিনের ছাউনি বসানো পর্যন্ত শেষ। ৭-৮ জন কর্মচারী একটি অস্থায়ী অফিস পরিচালনা করছেন, কিন্তু বাইরে থেকে তাদের ডাকার চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি। যেন পুরো কার্যক্রমকে ঢাকা দিতেই এতো গোপনীয়তা।

    স্থানীয় ব্যবসায়ী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি দোকানের জন্য অগ্রিম ১০ লাখ টাকা নেয়া হচ্ছে। প্রথমে ৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে বুকিং নিশ্চিত করা হচ্ছে, দোকান বুঝে পেলে পরিশোধ করতে হচ্ছে বাকি ৫ লাখ টাকা। এরপর মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাড়া ধার্য। এই হিসাবে ১০০টি দোকানের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অন্তত ১০ কোটি টাকা। আর মাসিক ভাড়ায় প্রতি মাসে আয় করা হচ্ছে ২০ লাখ টাকারও বেশি।

    জেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ২০১৮ সালে উক্ত জমি সরকারি খাসজমি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। হাইকোর্টের একটি রিটের (১০৬৫৭/২০২৪) মাধ্যমে স্থগিতাদেশের চেষ্টা হলেও, পরে সরকার পক্ষ আপিল করে (আপিল নং ৩৭২৯/২০২৪) এবং স্থগিতাদেশ আদায় করে। ফলে, সরকারই জমির বৈধ মালিক।

    জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, "কক্সবাজারে তাঁকে কখনো কেউ দেখেনি। এমনকি যারা আদালতে তার হয়ে কাজ করেন তারাও তাকে সরাসরি চেনেন না। তিনি জীবিত কিনা সেটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।"

    বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নামে মামলা ঠুকে দখলের একটি ‘আইনি ছাতা’ তৈরি করে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী জমিটি গ্রাস করতে চাইছে। যেখানে জমির বাজারমূল্য দাঁড়াতে পারে কয়েকশ কোটি টাকার বেশি।

    জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর, প্রথম দফায় একদল দখলবাজ জোরপূর্বক জমি দখলের চেষ্টা করলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে তাদের সরিয়ে দেন। এরপর আবার ‘সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের পক্ষে’ দাবি করে নতুন করে ঘেরা দেওয়া হয় এবং শুরু হয় মাটি ভরাট ও দোকান নির্মাণের কাজ। সরকার পক্ষ থেকে আপিলের মাধ্যমে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশও আসে। জেলা প্রশাসন নিষেধাজ্ঞার সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো নজরদারি বা কঠোর অভিযান দেখা যায়নি। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে দখলকারীরা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম।

    উক্ত জমি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ঘোষিত ইসিএ 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা'র আওতাভুক্ত। এ ধরনের এলাকায় স্থাপনা নির্মাণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

    এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন জানান, "বিষয়টি আমার নজরে ছিল না। এখন তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"

    এদিকে সরকারি জমির দখল, নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ, টিনের ঘেরা দিয়ে দোকানপট্টি তৈরির দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতন নাগরিক, পরিবেশবাদী সংগঠন এবং নেটিজেনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন- কক্সবাজারের সৌন্দর্য ধ্বংস করে দখলদারদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। প্রশাসন কী ঘুমিয়ে আছে? বিভিন্ন পোষ্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে- এত বড় কর্মকাণ্ড দিনের আলোয় চলছে, অথচ প্রশাসন নীরব কেন?

    সরকারি খাসজমি দখলের ঘটনাটি কেবল আইনি বা সম্পত্তি সংক্রান্ত একটি ঘটনা নয়; এটি কক্সবাজারের পরিবেশ, সৌন্দর্য, এবং আইনের শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি এক আঘাত। যদি এখনই কঠোর আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে কক্সবাজার শুধু দখলদারদের স্বর্গরাজ্যেই পরিণত হবে না, দেশের পরিবেশ রক্ষার সর্বশেষ সীমারেখাও ভেঙে যাবে।

    সুগন্ধা পয়েন্টকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই বাণিজ্যিক লোভের শিকার হচ্ছিল শহরের অন্যতম উন্মুক্ত স্থানটি। একদিকে সৈকত দূষণ, অন্যদিকে দখল- দুটির কারণে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করলেও ফল হয়নি। এবার এই বহুল আলোচিত জমি দখলের ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সাধারণ মানুষ।

    পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চের নেতা রাজন চৌধুরী বলেন, “সাগরের ধারে সরকারের জমিতে কেউ এসে আদালতের নাম ব্যবহার করে দখল করবে আর প্রশাসন চুপ করে থাকবে- এটা কল্পনারও বাইরে।” তিনি আরও বলেন, “এটা একটা চরম উদাহরণ যে কীভাবে প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় অপরাধী চক্ররা কক্সবাজার দখলের নগরীতে পরিণত করছে।”

    এই খবর ভাইরাল হওয়ার পরপরই নেটমাধ্যমে শুরু হয়েছে প্রতিবাদের ঝড়। অনেকেই লিখছেন, “এটা সরকার বনাম দখলদার চক্রের লড়াই নয়, এটা জনগণের জীবিত থাকার লড়াই।” আরও কেউ কেউ বলছেন, “এই দখলের পেছনে যদি জেলা প্রশাসনের কেউ জড়িত থাকে, তবে সেটা জনসমক্ষে আনতে হবে। সাংবাদিকদের অনুসন্ধান এবং জনগণের আন্দোলনেই বাঁচবে সুগন্ধা।”

    জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাহউদ্দিনও বলেন, খুবদ্রুত সময়ের মধ্যে আমার লোক যাবে, দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

    এসআর

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    সর্বশেষ প্রকাশিত

    Loading…