আজ পহেলা মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শহরে ব্যানার, স্লোগান আর মিছিলের গর্জনে শ্রমিকের অধিকারের কথা উঠলেও নিঃশব্দ থেকে যায় এক প্রান্তিক শ্রেণি—উপকূল অঞ্চলের নারী মৎস্যজীবীরা। তাঁদের দিন শুরু হয় ভোরে, শেষ হয় ক্লান্ত দুপুরে। নদীর বুকে একাকী জাল টেনে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরেন—তবু সরকারি তালিকায় তারা ‘জেলে’ নন।
সাতান্ন বছরের মনোয়ারা বেগম, গলাচিপার আগুনমুখা নদীর ঘাটে নৌকা নিয়ে নামেন সূর্য ওঠার আগেই। ৩০ বছর ধরে নদীতে মাছ ধরছেন, কিন্তু আজও মেলেনি জেলে কার্ড।
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘এতদিন মাছ মারছি, জাল বাইছি, কিন্তু এখনো কাগজে আমি জেলে না। মহিলা হইয়া কি জেলে হওয়া যায় না?’
পুরুষ সহকর্মীরা সরকারি সহায়তা পেলেও নারী হওয়ায় মনোয়ারা বঞ্চিত। ভিজিএফ চাল, প্রণোদনা বা দুর্যোগকালীন ত্রাণ—কোনো কিছুরই ভাগীদার নন তিনি।
মানতা সম্প্রদায়ের নারীরাও মুখ খুলছেন এ নিয়ে।
গোলাভানু বেগম, পেশায় নারী জেলে। নদীতে জন্ম, নদীতেই জীবিকা। কিন্তু রাষ্ট্র তাকে জেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাঁর প্রশ্ন—‘এই দুঃখ কই রাখি?’
সরকারি হিসাব বলছে, দেশে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৭ লাখ ৬৪ হাজার। কিন্তু এর মধ্যে নারী জেলের সংখ্যা নেই। পটুয়াখালীতেই নারী মৎস্যজীবী রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার, অথচ মাত্র ৫০০ জন পেয়েছেন নিবন্ধন।
ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর গবেষক সাগরিকা স্মৃতি জানান, ‘নারী জেলেরা পুরুষদের তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন। ৯৩ শতাংশ নারী জেলে কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। কিন্তু তারা সবথেকে কম কথা বলার সুযোগ পান'
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘নারী জেলেরা মৎস্যখাতের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হলেও তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আজ মে দিবসে তাদের কথা না বললে এই দিবসের দাবি শুধু স্লোগানেই রয়ে যাবে।’
গলাচিপা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জহিরুন্নবী বলেন, 'মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের নিবন্ধনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে নারীরাও সরকারি সহায়তার আওতায় আসবেন।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সম্প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে নারী মৎস্যজীবীদের নিবন্ধনের বিষয়ে নির্দেশনা এসেছে, কাজ শুরু হয়েছে।
তবে বাস্তবতায় এখনো তেমন অগ্রগতি নেই। যদি বাস্তব কার্যক্রম দ্রুত শুরু হয়, তবে হয়তো নারী বলে নয়—জেলে বলেই পরিচিতি পাবেন উপকূলের এই অক্লান্ত নারীরা।
এনআই