এইমাত্র
  • টরন্টোতে প্রদর্শিত হলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা ‘সাবিত্রী’
  • মুসলিম নারীর নিকাব টেনে খুলে ফেলায় সমালোচনার মুখে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী
  • ‘নিরাপত্তা’র কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন বিএনপি প্রার্থী
  • রেকর্ড দামে কলকাতায় ক্যামেরন গ্রিন
  • মহান মুক্তিযুদ্ধের নায়ক থেকে রূপালি পর্দায়
  • ‘ফিফা দ্য বেস্ট’ ঘোষণা আজ, যারা আছেন আলোচনায়
  • মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক
  • দেশে ফিরলেই গ্রেপ্তার হবেন অজুর্না রানাতুঙ্গা
  • লন্ডনে তারেক রহমানের শেষ কর্মসূচি আজ
  • মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ইতিহাসের ৯০ ভাগই মিথ্যা: আমির হামজা
  • আজ মঙ্গলবার, ২ পৌষ, ১৪৩২ | ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫
    দেশজুড়ে

    মেরিনড্রাইভের টেকনাফ অংশে ৬ ‘সম্রাটের’ রাজত্ব

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ০৮:৩৯ পিএম
    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ০৮:৩৯ পিএম

    মেরিনড্রাইভের টেকনাফ অংশে ৬ ‘সম্রাটের’ রাজত্ব

    শাহীন মাহমুদ রাসেল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (কক্সবাজার) প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ০৮:৩৯ পিএম

    কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিনভর থাকে পর্যটকের পদচারণায়, আর রাত নামলেই তা পরিণত হয় ছয়জন ইয়াবা সম্রাটের ‘নিরাপদ করিডোরে’। টেকনাফ অংশে তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ- যাদের অনুমতি ছাড়া সাগরে একটি ট্রলারও নোঙর করতে পারে না। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান পাড়ি জমায় বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে এই উপকূলে। পাহাড় ও স্থল সীমান্তে নজরদারি বাড়লেও সমুদ্রপথ এখন সবচেয়ে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এই রুটের প্রতিটি ইঞ্চি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একেকজন গডফাদারের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে।

    স্থানীয়দের ভাষায়- মেরিন ড্রাইভের এই অংশ এখন আর পর্যটনের পথ নয়, হয়ে উঠেছে ইয়াবার অঘোষিত করিডোর। নামেমাত্র টহল, দুর্বল নজরদারি আর প্রভাবশালী মাদক চক্রের ছায়ায় রাতভর চলছে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা কারবার।

    এই ৬ ‘সম্রাট’ হলেন, টেকনাফ সদরের গোদার বিল এলাকার মৃত কালা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ কাসিম (৩০) ও মোহাম্মদ সৈয়দ কাসিম (৩৬), একই এলাকার মৃত নজির আহমদের ছেলে জয়নাল আবেদীন (৩৩), সাবরাং বাহারছড়া এলাকার মৃত আবদু সালামের ছেলে জাফর আলম ওরফে বেঁজী জাফর (৩৬), মহেশখালিয়াপাড়ার আবদুল হাসিমের ছেলে মাহমুদুল হক (৩৭) ও আজিজুল হক (২৭)।

    তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে একাধিক ইয়াবার মামলা। কিন্তু ক্ষমতার ছায়ায় থেকে তারা শুধু বেঁচে নয়, বরং ফুলেফেঁপে উঠেছে।

    স্থানীয় সূত্র ও একাধিক তথ্য অনুযায়ী, তারা সবাই ইয়াবা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ও বঙ্গোপসাগর ঘাটভিত্তিক মাদক খালাস চক্রের মূল কুশীলব। তাদের প্রত্যেকের নামে বড় কোন মাদকের মামলা কিংবা তেমন আলোচনা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় থেকে তারা এখন 'অস্পৃশ্য ক্ষমতা'য় পরিণত হয়েছে।

    অভিযোগ উঠেছে, ৫ আগস্টের পর সীমান্তে বিজিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়লে বদলে যায় ইয়াবা পাচারের রুট। পুরোনো সিন্ডিকেটগুলো সীমান্ত ছেড়ে বঙ্গোপসাগরকেই বেছে নেয় নিরাপদ করিডর হিসেবে। এই নতুন পথে ইয়াবা খালাসের দায়িত্ব নেয় টেকনাফের এই ছয় প্রভাবশালী। যারা একরাম, আবদুর রহমান সিন্ডিকেটের পুরোনো ডনদের পক্ষে ‘চুক্তিভিত্তিক ডিলার’ হিসেবে কাজ করেন। প্রতিরাতে তাদের নিয়ন্ত্রণে বঙ্গোপসাগরের একাধিক ঘাটে খালাস হয় লাখ লাখ ইয়াবা। কমিশন হিসেবে প্রতি পিসে তারা নেন ৭ থেকে ৮ টাকা, ফলে একেকটি চালানেই তাদের আয় দাঁড়ায় কয়েক লাখ টাকা। এই টাকায় গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত ফিশিং ট্রলার, জমিজমা, বিলাসবহুল গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- গোপনে বিস্তৃত করেছেন তাদের অপরাধ সাম্রাজ্য।

    ‘রেইনড্রপ’ রেস্তোরাঁ- সিন্ডিকেটের সদর দপ্তর:

    সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের পাশে ‘রেইনড্রপ’ নামে রেস্তোরাঁটি এখন এই মাদক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলে পরিকল্পনা, ডিলিং, মাদকপথে লোক ম্যানেজিং ও বিপুল অঙ্কের লেনদেন। এই রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন বসে সিন্ডিকেটের গোপন বৈঠক। স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ‘রেইনড্রপ এখন টেকনাফের মাদকরাজনীতির ‘ওয়ার রুম’।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই গ্রুপের মূল ঘাটগুলো হলো, মহেশখালিয়াপাড়া ঘাট, টেকনাফ মেইন ঘাট, বাহারছড়া ঘাট, মুক্তার ডেইল ঘাট। এই ঘাটগুলো দিয়ে তারা ইয়াবা ট্রলার থেকে খালাস করে গুদামে পৌঁছে দেয়। ব্যবহার করে বিশেষ ধরনের ভক্সি ও শটবডি গাড়ি। পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে গাড়িগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে।

    অভিযোগ আছে, শুধু ইয়াবা নয়, এই চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মালয়েশিয়াগামী মানবপাচার সিন্ডিকেটও। তাদের ঘাট থেকে রওনা হয় অবৈধ যাত্রী বোঝাই ট্রলার। এমনকি অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আরও ভয়ংকর তথ্য- রাখাইন রাজ্যের বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন ‘আকান আর্মি’র কাছেও নিয়মিত রসদ পাঠানো হয় এই রুট দিয়ে। তাদের পাঠানো পণ্য তালিকায় রয়েছে সিমেন্ট, জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি।

    স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ছয়জনকে নিয়মিত আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন একজন জনপ্রতিনিধি। তাদের কোনো সদস্য ধরা পড়লে বা কোনো অভিযান পরিচালিত হলে সেই জনপ্রতিনিধির ফোনেই থেমে যায় অভিযান। অভিযোগ উঠেছে, কয়েকজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধি তাদের বিনিয়োগে লাভ পান বলেই তারা 'অদৃশ্য প্রটেকশন' পান।

    তাদের মতে, মেরিনড্রাইভ এখন আর কেবল পর্যটনের রোমাঞ্চ নয়, এটি হয়ে উঠেছে দক্ষিণাঞ্চলের একটি অঘোষিত মাদকবন্দর। রাষ্ট্রযন্ত্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছয়জন ইয়াবা সম্রাট গড়ে তুলছে কোটি কোটি টাকার অপরাধ সাম্রাজ্য, যা মুছে দিচ্ছে সীমান্ত নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব- সবকিছুকে।

    সূত্রের ভাষ্যমতে, এই চক্রের সদস্য জাফর আলমের কোমরে সবসময়ই থাকে একটি বিদেশি পিস্তল। অস্ত্রধারী অবস্থায়ই তিনি ঘাট ও সিন্ডিকেটের কার্যক্রম তদারকি করেন।

    এক স্থানীয় মৎস্যজীবী বলেন, “মাছ ধরার কাজ করি, কিন্তু মেরিনড্রাইভের আশপাশে কী হচ্ছে, তা জানি না। তবে জানি, অনেক দিন ধরেই ওখানে ইয়াবা খালাস হচ্ছে। এক রাতে আমি দেখেছিলাম, ছোট ছোট ফিশিং ট্রলার দিয়ে ইয়াবা খালাস করা হচ্ছিল। আমি নিজেও ভয় পেয়েছিলাম, কারণ ওই ট্রলারগুলোর মাঝি সবার হাতে অস্ত্র ছিল।”

    এক তরুণ শিক্ষার্থী বলেন, “মেরিনড্রাইভে গেলে সবাই বলে, সন্ধ্যার পর বের হয়ো না। কারণ, ওই সময় সেখানে ওই ছয়জন মাফিয়া তাদের রাজত্ব গড়ে তোলে। স্থানীয় মানুষজন বলেন, ওই ছয়জনের কথা না বললেই ভালো। তারা খুবই শক্তিশালী। তাদের কাছে কারো কিছু বললে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে।”

    এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এরা আমাদের এলাকার ভয়ঙ্কর শক্তি। রাতের বেলা মেরিনড্রাইভে যা হয়, আমরা কেউ কিছুই জানি না। আমরা জানি, ইয়াবা খালাস করার জন্য ওই ছয়জনের হাতে পুরো সড়ক চলে গেছে। তারা সাগর থেকে ইয়াবা তুলতে আর আমরা তাদের কাছে ব্যবসা করতে যেতে বাধ্য হই। প্রশাসন কিছুই করতে পারে না, কারণ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বড় বড় লোকজনের।”

    এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত জাফর আলম ওরফে বেজি জাফরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। ফোনালাপের একাধিক পর্যায়ে সংযোগ বিঘ্নিত হয়। কথোপকথনের একপর্যায়ে ফোনটি ধরেন একই সিন্ডিকেটের সদস্য জয়নাল আবেদিন। তিনি জানান, "আমরা বর্তমানে সাগরে আছি, এজন্য নেটওয়ার্ক সমস্যা হচ্ছে। আমরা ল্যান্ডের ব্যবসা করি, মাদকের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই- মাদক চোখেও দেখিনি।"

    পরে জাফর আবার ফোনে এসে বলেন, “আমাদের নিয়ে কেউ কিছু লিখলে কে তথ্য দিয়েছে, বা কী ডকুমেন্ট আছে তা জানাতে হবে। না হলে আমরাও বিভিন্ন দপ্তরে যাবো।” কথোপকথনের সময় ফোনের অপর প্রান্তে ওই সিন্ডিকেটের আরও কয়েকজনের কণ্ঠ শোনা যায়।

    এ বিষয়ে জানতে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

    এমআর

    সম্পর্কিত:

    সম্পর্কিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি

    সর্বশেষ প্রকাশিত

    Loading…