ক্ষুদ্রঋণ খাতে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা আনতে দেশে অচিরেই চালু হচ্ছে মাইক্রোফাইন্যান্স ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো- এমএফ-সিআইবি সিস্টেম, যা ব্যাংক ঋণের সিআইবি-এর মতোই কাজ করবে। এই সিস্টেমটি ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতাদের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করবে, যাতে একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে না পারেন এবং ঋণ খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কারিগরি সহায়তায় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) তত্ত্বাবধানে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সিস্টেমটি পুরোপুরি চালু হলে এটি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণ তথ্যভাণ্ডার। চলতি ডিসেম্বর কিংবা আগামী জানুয়ারি মাস থেকে ক্ষুদ্রঋণের সিআইবি কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এই তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণগ্রহীতার ঋণ বিবরণী বিশ্লেষণ করে যোগ্য গ্রাহককে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ প্রদান এবং ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় করণীয় নির্ধারণে সক্ষম হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঋণগ্রহীতার প্রকৃত সংখ্যা, একজন ঋণগ্রহীতা কতটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছেন, ঋণের পরিমাণ এবং ঋণের সার্বিক চিত্র (পরিশোধ, কিস্তির সংখ্যা সম্পর্কে তথ্য), বকেয়া, খেলাপি-এ জাতীয় তথ্য পাওয়া যাবে সিআইবির মাধ্যমে। ফলে ঋণের যে কোনো ধরনের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গ্রহণ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সহজ হবে।
ক্ষুদ্র ঋণ এখন আর শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও বিস্তৃত হচ্ছে এই ঋণ। বর্তমানে ক্ষুদ্র ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ যাচ্ছে ক্ষুদ্র উদ্যোগে। আবার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্রমবিকাশ হচ্ছে। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এখন আর ক্ষুদ্র নেই। আবার ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন ক্ষুদ্র ঋণ দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণের পরিধি বদলে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো এক সময় শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ দিত। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোগে ঋণ দেওয়া শুরু করেছে।
আলাপকালে এমআরএ কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে একজন ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহক কোথা থেকে ঋণ নিচ্ছেন, কত টাকা ঋণ নিচ্ছে-এ ধরনের তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে ঋণের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় না। গ্রাহক সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হয় না। ফলে ভালো গ্রাহকও অনেক সময় ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না, কিন্তু মন্দ গ্রাহক ঋণ পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা থাকে। সিআইবি চালু হলে এ ধরনের ঝুঁকির পরিমাণ কমবে বলে মনে করছেন তারা।
এমআরএ সূত্রে জানা গেছে, সিআইবি সিস্টেমে নির্ভুল ও সঠিক তথ্য নিশ্চিত করতে সিস্টেমে গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই শেষ পর্যায়ে। প্রায় তিন কোটি ৫৫ লাখ ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে একজন গ্রাহককে তার জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমেই শনাক্ত করা হয়। এ কারণে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করা হচ্ছে।
এনজিও ও ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা জানান, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। অনেক সময় ভুয়া আইডি ব্যবহার করে ভুয়া গ্রাহক ঋণ নিয়েছে। কিংবা একজনের আইডি ব্যবহার করে অন্য ব্যক্তি ঋণ নিয়েছে। সিআইবি চালু হলে এ ধরনের ভুয়া ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে এবং এ খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে। কিন্তু এর জন্য ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বাড়বে। তবে এ ব্যয় যাতে গ্রাহককে বহন করতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করা উচিত।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির সিআইবি ম্যানেজমেন্ট শাখার যুগ্ম পরিচালক মো: সাহিদুল হাসান সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘পাইলট প্রকল্প প্রায় শেষ বলা যায়। আমরা ৫০০ ব্রাঞ্চ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ব্রাঞ্চের ডাটা আপডেট করা হয়ে গেছে। এ কাজে একটি বড় ইস্যু দাঁড়িয়েছিল- এনআইডি ইস্যু। ওইটা সমাধান হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র ঋনদাতা প্রতিষ্ঠান আছে ৬৮৩টি। গ্রাহক আছেন ৪ কোটির ওপরে। তবে, ঋণগ্রহিতা আছেন ৩ কোটি ২০ লাখ।’
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘আমাদের এই তথ্যভান্ডারটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তথ্যভান্ডার। ইতোমধ্যে পাইলট প্রকল্পের কাজ শেষ বলা যায়। অতি শিগগিরই সিআইবি সিস্টেমটি চালু করা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এতে সহযোগিতা করায় এই সিস্টেমের কাজটি আরও দ্রুত করা গেছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ৩ কোটিরও বেশী জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই সম্পন্ন হয়েছে।’
ইয়াকুব হোসেন আরও বলেন, এমএফ-সিআইবি বাস্তবায়নের ফলে একটি রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ হিসেবে এমআরএ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে একধাপ এগিয়ে যাবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই যুগে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিজের সেবা এবং কার্যক্রমকে জনগণের চাহিদার সঙ্গে খাপ-খাপিয়ে অটোমেটেড এবং ডিজিটালাইশন করা গুরুত্বপূর্ণ।’
এ প্রসঙ্গে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ মুঠোফোনে সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। যেসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে ব্যাংক ঋণ পাওয়া অসম্ভব, তাদের অর্থায়ন করছে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণের কোনো কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার না থাকায় ঋণগ্রহীতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিল না। এখন সিআইবির মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার প্রকৃত তথ্য যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি ঋণের তথ্য বিশ্লেষণ করে পলিসিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সহায়ক হবে।’
ইখা