বয়স মাত্র ১২। জীবনের পিচে পা রেখেই যে শিশুটি স্বপ্ন বুনেছিল ক্রিকেট নামক খেলার ২২ গজে দাঁড়িয়ে একদিন তামিম–মুশফিকদের কাতারে পৌঁছানোর, সেই রাহাত খান আজ আর নেই। সীমানার বাইরে বল পাঠাতে চাওয়া এই কিশোর এবার নিজেই চলে গেছে জীবনের সীমানার ওপারে। রেখে গেছে না বলা স্বপ্ন, চোখ ভেজানো স্মৃতি আর অনুশীলন সঙ্গীদের অন্তহীন শূন্যতা।
রাহাত খান—ব্রাদার্স ক্রিকেট একাডেমির একটি উজ্জ্বল নাম। চান্দগাঁওয়ের অলি–গলিতে বেড়ে ওঠা এই কিশোর ছেলেটি মাঠে ছিল সাহসী, ব্যাটে ছিল আগ্রাসী, উইকেটের পেছনে ছিল দুর্দান্ত। উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান হিসেবে তার প্রতিভা এতটাই চমকপ্রদ ছিল, দুই বছর আগেই অনূর্ধ্ব–১০ ক্রিকেট কার্নিভ্যালে নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের সেই ছোট্ট অধিনায়ক ছিল যেন ভবিষ্যতের বড় কোনো প্রত্যাশার আগাম বার্তা।
কিন্তু কে জানতো, এত অল্প বয়সেই তাকে চলে যেতে হবে সব ট্রফি, মেডেল, ব্যাট, গ্লাভস, হেলমেট আর সেই কাঁচা–ঘামে ভেজা অনুশীলনের মায়া ছেড়ে। আজ সেই কাচের শোকেসে রাহাতের অর্জনের ঝলক থাকলেও, বাবা লেয়াকত আলীর ঘরে নেই তার উজ্জ্বল মুখ। নেই সেই কান্না থামানো হোক এমন স্বপ্নবাক্য—"একদিন মা, তোমাকে আমি বিমানে চড়াবো। বড় ক্রিকেটার হবো আমি!"
"মোমিন স্যার বলেছেন বল সীমানার বাইরে পাঠাতে!" রাহাত যখন বল ডিফেন্স করতে বললে উল্টো জোরে মেরে ফেলে দিত, তখন জুনিয়র কোচরা হেড কোচ মোমিনুল হকের কাছে অভিযোগ করত। মোমিনুল হক স্মৃতি হাতড়ে সময়ের কণ্ঠস্বর-কে বলেন, "এমন মেধাবী ক্রিকেটার আমি খুব কম দেখেছি। আমাদের একাডেমির অধিনায়ক ছিল রাহাত। মাঠে নেতৃত্বের দক্ষতা ছিল অবাক করার মতো। মেয়র কাপ অনূর্ধ্ব–১৪ টুর্নামেন্টে খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। অথচ এখন তার জায়গাটা থাকবে ফাঁকা।"
পাড়ার আরেক ক্রিকেটার নাঈম ইসলাম বর্তমানে জাতীয় দলে খেলছেন। রাহাত তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হতো। অনুশীলনে কখনও অনুপস্থিত থাকত না সে। অনূর্ধ্ব–১০ ক্রিকেট কার্নিভ্যালে দুটি হাফসেঞ্চুরি করা রাহাতের দুঃখ ছিল, কোনো দিন সেঞ্চুরি করতে পারেনি। কোচরা আশ্বাস দিতেন—“তুমি অনেক বড় খেলোয়াড় হবে, তখন সেঞ্চুরির অভাব থাকবে না।” অথচ সেই স্বপ্ন আজ ধুলোয় লুটাচ্ছে তার বন্ধুরা, কোচ, পরিবার আর নগরবাসীর চোখে জল এনে।
সবশেষে প্রশ্ন থেকে যায়—একটি সম্ভাবনাময় প্রাণ অকালে ঝরে গেল কেন?
স্কুলের সহপাঠীদের নির্মমতায়, প্ররোচনায়, কিংবা মরণঘাতী খেলাধুলায়? স্থানীয়রা বলছেন, দুষ্টু বন্ধুদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াই ছিল রাহাতের জীবনের ট্র্যাজিক পরিণতির সূচনা। নিছক কৌতূহল, অথবা বাধ্য হওয়া—যে কারণেই হোক, মায়ের হাত ধরে আউটার স্টেডিয়ামে যাওয়া শিশুটি আর ফিরল না মাঠে।
আজও ব্রাদার্স ক্রিকেট একাডেমির নেট প্র্যাকটিস চলবে। কোচরা নির্দেশনা দেবেন। বোলার বল করবে, ব্যাটার মারবে। কিন্তু কেউ আর উইকেটের পেছন থেকে বলবে না—"বলটা সোজা কর", "জায়গায় বল ফেলো"।
কারণ রাহাত খান নেই। যে জীবনের বলটিকে সীমানার বাইরে পাঠাতে চেয়েছিল, সে নিজেই আজ চলে গেছে সীমানার বাইরে।
এসআর