ভোরের আলো পুরোপুরি ফোটার আগেই কর্ণফুলী নদীর ১৫ নম্বর জেটি ঘাটে জমে ওঠে মানুষের ভিড়। কারও গন্তব্য অফিস, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ প্রবাসযাত্রার প্রস্তুতিতে, কেউবা বিদেশফেরত। সবার চোখ একদিকে, নদীর ওপার। এরই মধ্যে নদীজুড়ে ঘন কুয়াশা। ১০ ফুট দূরের কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। অথচ নদীর তলদেশে দেশের অন্যতম বড় অবকাঠামো কর্ণফুলী টানেল থাকা সত্ত্বেও এসব মানুষের পা পড়ে পুরোনো, ঝুঁকিপূর্ণ সেই খেয়া ঘাটেই। নৌকা, স্রোত আর অনিশ্চয়তার মাঝেই প্রতিদিন শুরু হয় অন্তত ৪-৫ হাজার মানুষের যাত্রা।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে চালু হয়েছিল কর্ণফুলী টানেল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আনোয়ারা ও কর্ণফুলীর বহু মানুষের কাছে টানেল এখনো দূরের স্বপ্ন, আর খেয়া নিত্যদিনের বাধ্যতামূলক বাস্তবতা।
রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) ভোরে সরেজমিনে ১৫ নম্বর জেটি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, নদীর দুই পাড়ে মানুষের দীর্ঘ সারি। একের পর এক খেয়া নৌকা ঘাটে ভিড়ছে, আবার যাত্রী বোঝাই করে ছুটে যাচ্ছে নদীর বুকে। অফিসগামী মানুষ, প্রবাসযাত্রী, শিক্ষার্থী ও শ্রমজীবীদের ব্যস্ততায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।নৌকায় ওঠা যাত্রীদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এটা শখের ঝুঁকি নয়, প্রয়োজনের ঝুঁকি।
খেয়া ঘাটে কথা হয় মাঝি আবুল কালামের সঙ্গে। বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। গত ২৫ বছর ধরে এই নদীতেই তার জীবন। তিনি বলেন, ‘টানেল হইছে ঠিকই, কিন্তু খেয়া তো বন্ধ হয় নাই। বরং যাত্রী আগের মতোই আছে। সকালে আর বিকালে চাপ বেশি, দুপুরে একটু কমে।’
বাংলাদেশ নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সিরাজুম মুনিরা বলেন, 'টানেল ব্যবহার করতে গেলে অনেক ঘুরতে হয়, খরচও বেশি। আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রদের জন্য খেয়াই সহজ।’
মেরিন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সিপরাত মোহাম্মদের কথায় উঠে আসে বাস্তব চিত্র, ‘বর্ষাকালে খেয়া পার হওয়া সবচেয়ে কষ্টের। ঢেউ বেশি থাকলে নৌকা দুলতে থাকে। তবুও পড়াশোনার জন্য বাধ্য হয়ে উঠতে হয়। ১৫ নম্বর ঘাট দিয়েই স্কুল কাছাকাছি।’
সিইপিজেডের একটি গার্মেন্টসে কর্মরত শ্রমিক রাজিব ঘোষ বলেন, 'সকালের শিফটে দেরি হলে হাজিরা কাটা যায়। টানেল দিয়ে গেলে অনেক ঘুরতে হয়, খরচও বেশি। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও সময় বাঁচানোই আমাদের কাছে বড়।'
অপর গার্মেন্টসকর্মী শিরিন আক্তার বলেন, ‘দিনে দুইবার নদী পার হই। সন্ধ্যায় ফেরার সময় বেশি ভয় লাগে। লাইট ঠিকমতো থাকে না, লাইফ জ্যাকেটও নাই।’
খেয়ায় পার হতে সময় লাগে মাত্র ১০-১৫ মিনিট। অথচ টানেল ব্যবহার করতে গেলে সংযোগ সড়ক ঘুরে দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগে। স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে তাই খেয়াই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বিকল্প। এই বিকল্প যে কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ খেয়া নৌকায় নেই পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট, নেই যাত্রীসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ। বর্ষা মৌসুমে নদীর স্রোত বেড়ে গেলে আতঙ্ক আরও বাড়ে। তবুও নৌকায় উঠতেই হয়, না উঠলে জীবন যেন থমকে দাঁড়ায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. লিটন বলেন, 'টানেল দেশের জন্য বড় সম্পদ। কিন্তু এই ঘাটও আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসবে।'
ঘাটে কর্মরত মাঝিমাল্লা ও ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৫ নম্বর জেটি ঘাটে বর্তমানে মোট ৪০টি বোট থাকলেও নিয়মিত চলাচল করে মাত্র ৮টি। প্রতিটি বোটে একবারে সর্বোচ্চ ২৫ জন যাত্রী পরিবহনের অনুমতি রয়েছে। একটি বোট দিনে গড়ে ৮ থেকে ১০ বার নদী পারাপার করতে পারে। তবে যাত্রীচাপ ও বোট ব্যবস্থাপনার কারণে একদিন চলার পর পরবর্তী পাঁচ দিন বোটগুলোকে বসিয়ে রাখতে হয়। মাঝিমাল্লাদের ভাষ্য অনুযায়ী, টানেল চালুর আগে যেখানে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী পারাপার হতো, বর্তমানে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজারে। তবুও অফিসগামী ও শ্রমজীবী মানুষের ভরসা এখনো এই খেয়া পারাপারই।
মাঝি মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, '১৫ নম্বর ঘাটে মোট বোট রয়েছে ৪০টি। এর মধ্যে দৈনিক চলে মাত্র ৮টি। একটি বোট দিনে সর্বোচ্চ ১০ বার যাতায়াত করতে পারে। এক বোটে নির্ধারিত যাত্রী ২০-২৩জন। একদিন চলার পর ৫ দিন বসে থাকতে হয়। সব মিলিয়ে দৈনিক এপার-ওপার যাত্রী যাতায়াত ৪-৫ হাজার।'
লাইনম্যান মো. আরমান বলেন, ‘আগে দৈনিক ১০-১৫ হাজার যাত্রী পরিবহন হতো। এখন তা কমে ৪-৫হাজারে নেমেছে। লাইফ জ্যাকেট আছে, কিন্তু যাত্রীরা পরতে চায় না। তবুও প্রতিটি বোট ও ঘাটে অতিরিক্ত জ্যাকেট রাখা আছে। কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর তৎপরতায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি কিছুটা কম।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ নম্বর ঘাটটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন। ঘাট পরিচালনার জন্য সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক একজন ইজাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, টানেল থাকা সত্ত্বেও যে বিপুল সংখ্যক যাত্রী খেয়া পারাপারকে বেছে নিচ্ছেন, তার পেছনে রয়েছে একাধিক ভোগান্তির কথা। টানেল ব্যবহার করতে হলে অনেক যাত্রীকে প্রথমেই অতিরিক্ত দূরত্ব ঘুরে সংযোগ সড়কে যেতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ক্লান্তিকর। বিশেষ করে শিক্ষার্থী, প্রবাসী ও শ্রমজীবীদের জন্য টানেলমুখী পরিবহন সহজলভ্য নয়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে বাড়তি যানবাহন বদল, অনিয়ন্ত্রিত ভাড়া ও দীর্ঘ অপেক্ষা নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। টানেলে নির্ধারিত টোল সাধারণ মানুষের কাছে তুলনামূলক বেশি মনে হওয়ায় অনেকেই সেটিকে অপ্রয়োজনীয় খরচ হিসেবে দেখছেন। পাশাপাশি গণপরিবহনের নির্দিষ্ট সময়সূচির অভাব এবং টানেল এলাকায় যানজটের আশঙ্কাও যাত্রীদের নিরুৎসাহিত করছে।
জানতে চাইলে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার সময়ের কন্ঠস্বরকে বলেন, 'খেয়া পারাপারের ঝুঁকি কমাতে মাঝিদের নির্দেশনা দিবো এবং উভয় পক্ষকেই সতর্ক করবো।'
স্থানীয়দের মতে, বড় অবকাঠামো তখনই সফল, যখন তা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়। টানেলের টোল বা গণপরিবহনের ভাড়া কমানো না গেলে মানুষ পুরোনো পথেই ফিরবে।
এসআর