বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্মভিটে আজও সংরক্ষিত রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি জেলার নয়াবস্তি এলাকায়। মূলত এই এলাকার ওই পুরোনো বাড়ি আজও বহন করছে ইতিহাস। কারণ এখানেই জন্মেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। দেশভাগের পর পরিবারটি বাংলাদেশে চলে গেলেও জন্মভিটে রয়ে গেছে আগের মতোই। এই বাড়িটি এখনও যত্নে-আত্তিতে সংরক্ষণ করে রেখেছে বর্তমান মালিক পরিবার— যা স্থানীয়দের কাছে এক ঐতিহাসিক ঠিকানা।
জানা যায়, দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা অমরেন্দ্র চক্রবর্তী এই বাড়িটি ক্রয় করে। বর্তমানে তার ছেলের তত্ত্বাবধানেই জলপাইগুড়ি পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এই বাড়িটি দেখভাল করা হয়। খালেদা জিয়ার জন্মভিটে হিসাবে আজও বাড়িটি সংরক্ষিত অবস্থায় রেখেছেন চক্রবর্তী পরিবার। আর এই বাড়ি দেখভালের জন্য খালেদা জিয়ার আত্মীয়-স্বজন এখনও নিয়মিত যাতায়াত করেন ভারতে।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়ি জেলা শহরের নয়াবস্তির এক আভিজাত্যে ভরা শান্তির নীড় মুজমদার পরিবারে প্রচণ্ড খুশির বার্তা বয়ে ইস্কান্দার মজুমদারের ঔরস্যে ও বেগম তৈয়বা মুজমদারের গর্ভে জন্ম নেন খালেদা খানম পুতুল। তার বাবা ইস্কান্দার আলী মজুমদার পেশায় চা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদারের জন্ম উত্তর দিনাজপুর জেলার চাঁদবাড়ি গ্রামে, এই এলাকাটিও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর খালেদা জিয়ার পরিবার দিনাজপুরে চলে যায়। আর তা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অংশ হয়। ফলে জন্মসূত্রে ভারতের বর্তমান ভূখণ্ডে জন্ম হওয়ায় খালাদা জিয়া ভারত ছাড়লেও তার জন্মভিটে এখনও রয়েছে আগের মতোই।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, খালেদা খানাম পুতুলের পরিবারিক একটি বাগানবাড়ি ও একটি বসত ভিটে ছিল এই নয়াবস্তি এলাকায়। বর্তমানে সেই বাগানবাড়ি অস্তিত্ব হারালেও জন্ম ভিটে রয়েছে প্রায় আগের মতোই। স্থানীয়রা জানান, খালেদা জিয়াকে দেখেছেন বা তাদের পরিবারকে দেখেছেন এমন কেউই বর্তমানে বেঁচে নেই, তবে তারা তাদের পরিবারের বয়স্ক মানুষদের মুখে শুনেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই জন্মভিটের কথা। নয়াবস্তি এলাকার প্রায় প্রত্যেক বাসিন্দাই এই বাড়িটির ইতিহাস সম্পর্কে অবগত।
নয়া বস্তি এলাকার বাসিন্দা চামেলী বিশ্বাস বলেন, আমার মা আমাকে এই বাড়িটি সম্পর্কে বলেছেন। আমার বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই তার এই বাড়িটি। এই বাড়িটির মালিক বর্তমানে বাইরে থাকে। তার মৃত্যুর কথা শুনে অবশ্যই খারাপ লাগছে। মায়ের থেকে শুনেছি— আমাদের সঙ্গে তাদের খুব ভালো প্রতিবেশী হিসাবেই সম্পর্ক ছিল।
ইতিহাস বলে— ১৯৪৭ সালে মাত্র দুই বছর বয়সেই ভারত ছাড়েন খালেদা জিয়া। কিন্তু নয়বস্তি অবস্থা এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেরই দাবি দেশভাগের পরেও বেশ কিছুদিন ভারতে ছিলেন তারা। খালেদা জিয়া প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন স্থানীয় যোগমায়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরবর্তীকালে সুনীতি বালা সদর গার্লস স্কুলে।
স্থানীয় বাসিন্দা উৎপল গোপ বলেন, খালেদা জিয়ার মৃত্যুর সংবাদ আজ সকালে পেলাম। তার মৃত্যু আমাদের কাছে বেদনাদায়ক দুঃখজনক। আমাদের খারাপ লাগছে কারণ তার শৈশব এই পাড়াতে, এই বাড়িতেই কেটেছে। পড়াশোনাও তিনি শৈশবকালে এখানেই করেছেন। পরবর্তীকালে তারা এখান থেকে চলে গিয়েছেন। এই দিনটা আজকে শোক দিবস হিসেবেই আমরা মনে করছি। ওনার কৃতিত্বে আমরা গর্বিত, ওনার মৃত্যুতেও আমরা শোকাহত।
ইতিহাসবিদ উমেশ শর্মা বলেন, জলপাইগুড়িবাসীর গৌরব খালেদা জিয়া জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তারা তিন বোন ছিলেন , ডাকনাম হিসাবে তাদের লকেট, চকলেট, পুতুল হিসাবে ডাকা হতো। তবে বেগম খালেদা জিয়ার ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এর সত্যতা খুব একটা জানা যায় না। তবে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত তিনি এখানে পড়েছিলেন বলে আমরা জানি।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা ভোলা মন্ডল বলেন, এই বাড়িটি তাদের ছিল। বাংলাদেশ থেকে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী এই বাড়িটি কেনেন। এই বাড়িটি দেখভালের জন্য খালেদা জিয়ার আত্মীয়-স্বজনরা নিয়মিত এখানে আসেন। এই বছরও তারা এসেছিলেন। তারা নিজেদের ভিটে দেখতে আসেন।
তিনি আরও বলেন, মায়ের কাছে শুনেছি খালেদা জিয়া যখন কোলের শিশু তখন একদিন সকালে তারা দেশছেড়ে চলে যায়। হিন্দু মুসলিমরা সেসময় তাদের বাড়িঘর এক্সচেঞ্জ করেছিলেন। চক্রবর্তী পরিবার সম্ভবত বাড়ি এক্সচেঞ্জ এর মাধ্যমে এই বাড়িটি পেয়েছিলেন। বর্তমানে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী পরিবার এই বাড়িতে দেখভাল করেন।
সদর প্রাথমিক মহিলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, শুনেছি খালেদা জিয়া এই স্কুলেই বেশ কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলেন। তার মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। স্কুল এখন ছুটি চলছে। নতুন বছরে স্কুল খোলার পর এখানে কোনও শোকসভা করা যায় কিনা সেই ব্যাপারে আলোচনা করব।
এবি