টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ফলদা ইউনিয়নের গুজাবিল নামের একটি ঐতিহ্যবাহী উন্মুক্ত জলাশয় ঘিরে দখল ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। মাত্র ২৪ একর খাস জমির সরকারি ইজারা নিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় ২০০ একরেরও বেশি জলাশয়জুড়ে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে কয়েকজন বিএনপি নেতা। এতে বর্ষা মৌসুমে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা দরিদ্র মৎস্যজীবী পরিবার ও স্থানীয় কৃষকরা চরম দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দখলচেষ্টায় জড়িতরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন না। ক্ষতির আশঙ্কা থাকলেও অনেকে নীরব রয়েছেন। যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে বা বিভিন্নভাবে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা চলছে।
তাঁরা জানায়, মাছ চাষের উদ্দেশ্যে গুজাবিলের বিভিন্ন প্রবেশমুখে সম্প্রতি বাঁশ, জাল ও চাটাই দিয়ে একাধিক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁধগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে যে বর্ষার সময় বাইরের পানি প্রবেশের সুযোগই থাকবে না, যার ফলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হবে। এতে শুধু মাছের প্রজননেই নয়, বিলসংলগ্ন ফসলি জমিতে আমন ধানের আবাদেও ক্ষতি হতে পারে। কারণ কার্প জাতীয় মাছ অনেক সময় চাষের জমিতে ঢুকে ধানের চারা খেয়ে ফেলে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জনগুরুত্বপূর্ণ উন্মুক্ত জলাশটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঝিনাই নদী। এ নদী থেকে পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার কয়েকটি খালের অবস্থান এ বিলে। সম্প্রতি ইজারার নামে ব্যক্তি মালিকানা শত শত একর জমি ভেতরে রেখে খালের মুখে বাঁধ দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শত শত মৎস্যজীবী ও কৃষক পরিবার।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গুজাবিলে সরকারি খাস জমির পরিমাণ মাত্র ২৪ একর, যা সরকারিভাবে স্থানীয় একটি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। অথচ জলাশয় ঘিরে থাকা প্রায় ২০০ একর জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন, যেগুলোতে প্রতিবছর ধানসহ নানা চাষাবাদ হয়ে থাকে। স্থানীয়দের দাবি, ইজারা নেওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুরো বিল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন একটি চক্র।
সূত্র জানায়, জলাশয়টি মাছ চাষের জন্য ইজারাদারের কাছ থেকে নিয়েছেন উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। এদের মধ্যে পৌর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজল মিঞা, পৌরসভা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক রাজিব হোসাইন কফিল, যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন অন্যতম। তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছেন পৌর, ফলদা ইউনিয়ন বিএনপি ও যুবদল নেতারা। আর জলাশয়ের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিটি গ্রাম থেকে বিএনপির ঘনিষ্ঠ লোকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের পাশাপাশি বিএনপির ভেতরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ঈদুল আজহার পর ঝনঝনিয়া গ্রামের রেললাইনের ব্রিজসংলগ্ন একটি বাঁধ স্থানীয় গ্রামবাসী ভেঙে দেয়। পরে যাদের নেতৃত্বে বাঁধ ভাঙা হয়েছিল তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে পুনরায় সেখানে বাঁধ নির্মাণ করেন প্রভাবশালী পক্ষ। ফলে অভ্যন্তরীণভাবে বিএনপির ভেতরেই ক্ষোভ ও চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।

যদিও প্রভাবশালীদের ভয়ে বেশিরভাগ নেতাকর্মীই নিজেদের নাম পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁরা জানায়, এই জলাশয়টি বর্ষা মৌসুমে দেশীয় প্রজাতির মাছ আহরণের একটি অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি এ বিল থেকে শত শত পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। সেখানে দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি ব্যক্তি স্বার্থে মানুষের অধিকার হরণ করে, তাহলে সেটা আমাদের দলের জন্যও লজ্জার।
ঝনঝনিয়া গ্রামের এক কৃষকদল নেতা সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'দলের নাম ভাঙিয়ে আমাদের অনেককেই ম্যানেজ করেছে তারা। আমরা নিজেরা ঈদের পর ব্রিজের নিচে বাঁধ ভেঙে দিয়েছিলাম। কিন্তু সকলের বাধা উপেক্ষা করে আবার সেখানে বাঁধ দিয়েছে। এমনভাবে বাঁধ বসিয়েছে, মাছের পোনা তো দূরের কথা—বর্ষার পানি ঢোকাও কঠিন হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিলের জমি মূলত মালিকানাভুক্ত। সেটা তো তাদের নয়। তারা চন্ডিপুর মৌজায় ইজারা নিয়েছে, অথচ যেদিকে বাঁধ দিয়েছে সেটা তো মাইজবাড়ি মৌজা—সেখানে বিলই নেই। সেখানে বাঁধ দেওয়ার কোনো এখতিয়ার তাদের নেই।'
স্থানীয় ওয়ার্ড যুবদলের এক নেতা বলেন, 'প্রতিবছরই ঐ জলাশয় সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়। তবে শুধু সরকারি খাস জমিটুকুই ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু ইজারাদাররা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পুরো মানুষের আবাদি জমিসহ জলাশয়টা দখল করছে। এতে রাক্ষুসে মাছ এসে সাধারণ কৃষকদের খেতের ধান খেয়ে ফেলার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটা নিয়ে এলাকার ভেতরের মানুষের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হয়েছে।'
ঝনঝনিয়া এলাকার খলিলুর রহমান বলেন, 'এই জলাশয়ে আমরা ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে খাই। এখন যেভাবে দখল করা হচ্ছে, মনে হয় কাল থেকেই আর নামতে পারবো না। এছাড়া কিছু কার্প জাতীয় মাছ ধানের চারা খেয়ে ফেলে সেখানেও আমাদের ক্ষতি হয়। আমরা চাই এই জলাশয় আগের মতই উন্মুক্ত থাকুক। সবাই যেন মাছ ধরতে পারে। কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে যেন পরিণত না হয়। এই জলাশয়ের শত শত বিঘা জমি আমাদের মত গরিবদের। আমাদের জমিতে আমরা মাছ ধরতে পারবো না, চাষাবাদ করতে পারবো না সেটা হবে না।'
উপজেলা যুবদলের সহ-সভাপতি রঞ্জু মন্ডল বলেন, 'এই জলাশয় সবার জন্যই উন্মুক্ত ছিল। এর আগে এখানে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। পরে সেই বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়। এখন আবার বাঁধ দিয়ে এই উন্মুক্ত জলাশয় দখলের চেষ্টা করেছে একটি প্রভাবশালী মহল। এর আগে কখনো এমন হয়নি। এর একটা প্রতিকার চাই।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইজারাদার গোবিন্দ চন্দ্র রাজবংশী সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, ‘আমরা ভূঞাপুর পৌর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির ২২ জন সদস্য মিলে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে গুজাবিলের সরকারি ২৪ একর জমি ছয় বছরের জন্য ইজারা নিয়েছি। এবং প্রতিবছর সরকারকে তিন লাখ টাকা রাজস্ব দিচ্ছি।’

একাধিক স্থানে এভাবে বাঁধ দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বিলের ইজারাকৃত জায়গা ২৪ একর কিন্তু যেখানে আড়াই ফুট পানি থাকবে সেখানে আমি যেতে পারব। সেটা যতদূরই যাক! এটা আমার বৈধতা আছে। এ বিষয়ে ইউএনও, এসিল্যান্ডকে আমরা বলেছি এবং স্থানীয়দেরও বার বার বলা হয়েছে। গতবার আমরা লোকসান গুনেছি। এবার আমরা বিএনপি নেতাদের দিয়েছি, যে আপনারা মাছ চাষ করে আমাদের কিছু লভ্যাংশ দিয়েন তাতেই হবে।'
জানতে চাইলে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিমা আক্তার সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'ওই জলাশয় এখনো ইজারাধীন। ইজারাদার তার ইজারাকৃত জলাশয়ের মাছের নিরাপত্তার জন্য বাঁধ দিতে পারে। বর্ষাকালে যখন পানি চলে আসে তখন তো তাদের মাছ চলে যাবে। সেক্ষেত্রে তারা ক্ষতির মুখে পড়বে। বর্ষাকালে যখন পানি থৈ থৈ করে, তখন কোনটা মালিকানা জমি আর কোনটা ইজারাকৃত জমি সেটা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না।'
স্থানীয়দের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, 'যদি ওই জলাশয়ে ব্যক্তি মালিকানা জমি থাকে তাহলে তাদেরকে জলাশয়টি যে সমিতির কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে, সেই সমিতিকে টাকা দিয়ে তাদের সাথে শেয়ার হতে হবে। তারা যদি এটা না মানে তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বলেন, 'আমি ইজারার একজন অংশীদার। স্থানীয়রাই তাদের স্বার্থে বাঁধ দিয়েছে।' পৌর বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফজল মিঞাও ইজারার কথা স্বীকার করেছেন।
তবে পৌরসভা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম হৃদয় এই জলাশয়ের সঙ্গে নিজ সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বলেন, 'গুজাবিল আমি পরিচালনা করি না, সেখানে আমার কোনো শেয়ারও নেই। তবে আমি যতটুকু জানি, এলাকার প্রতিটি গ্রাম থেকেই দুই-একজনকে নিয়ে বিল পরিচালনা করা হচ্ছে। যাদের মালিকানাধীন জমি আছে, তাদের সঙ্গেও একটি চুক্তি করা হয়েছে।'
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সেলিমুজ্জামান তালুকদার সেলু সময়ের কণ্ঠস্বরকে বলেন, 'এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার কাছে কেউ লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ করেনি। বিষয়টির সঙ্গে আমি জড়িতও না, তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।'
জানতে চাইলে ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আবদুল্লাহ খান জানান, 'আমি এ বিষয়ে এখনো কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'